ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক সহকর্মীকে ফেসবুকে আজ সকাল থেকে “Popular Now” দেখাচ্ছিলো। পপুলার হওয়ার মত কর্মই তিনি করেছেন বটে। গত ২২ জুলাই বিকালে তিনি ভগবানকে মদ্যপ সাজিয়ে ফেসবুকে একটি অনুগল্প লেখেন। কোন এক গ্রীস্মের দুপুরে ভগবান পৃথিবীতে এসে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ঢুলু ঢুলু চোখে এক দুধ বিক্রেতাকে অভিশাপ দিচ্ছেন- ইত্যাদি তাঁর গল্পের কাহিনী। বলাবাহুল্য, অসংখ্য মানুষ এই পোস্টে নানাভাবে রিয়্যাক্ট করেছেন। শত শত মানুষ কমেন্ট করে তাঁদের মতামত জানিয়েছেন এবং বহু মানুষ পোষ্টটি তাঁদের টাইমলাইনে শেয়ার করেছেন। এই সুবাদে আমার ফেসবুক বন্ধু না হাওয়া সত্ত্বেও ঐ অধ্যাপকের ‘অতি সৃজনশীল’ অনুগল্পটি আজ সকালে আমার নজরে আসে। এত মানুষ যখন তাকে নিয়ে কথা বলছেন, তিনি তো পপুলার হবেনই। আমার ধারণা, লেখক বিষয়টিকে রীতিমতো এনজয় করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখনো বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা সত্ত্বেও বিদ্বজ্জনেরা এখনো এই দাবিকে অস্বীকার করেন না। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র-শিক্ষক, গ্রাজুয়েট, অভিভাবকসহ দেশের আপামর জনসাধারণের মনে এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি গর্বের নাম। দেশের মানুষ এখনো এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রতি কিছু কিছু শ্রদ্ধা ও সমীহ প্রদর্শন করেন। কিন্তু আজ ঐ শিক্ষকের প্রতি সারা দেশের মানুষ যে ভাষায় অনুভূতি প্রকাশ করেছেন, তা দেখে আমার অন্যান্য সম্মানিত সহকর্মীদের নিশ্চিত বলতে ইচ্ছা করবে “ধরণী দ্বিধা হও”।
এটা অনস্বীকার্য যে, বর্তমানে আমাদের সামাজিক মনস্তত্ত্ব অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিকতর দূষণের শিকার। বহুদিন থেকেই সাম্প্রদায়িক অপশক্তি গুলোর মুখে “শতকরা নব্বই (কখনো পঁচানব্বই) ভাগ মুসলমানের দেশে” শব্দবন্ধটি প্রায় অনুসিদ্ধান্তের মত উচ্চারিত হচ্ছে। এর মর্মার্থ হল, এদেশে মুসলমান যেহেতু সংখ্যায় অনেক বেশি, সুতরাং অন্যান্য ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ের মানুষদের ধর্ম, জীবন, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি প্রশ্নে তাদের কথা শুনতে যাওয়া অনাবশ্যক। এতদিন আমরা ভাবতাম এসব কতিপয় পরাজিত সাম্প্রদায়িক অপশক্তির প্রোপাগান্ডা মাত্র। বাংলাদেশের উজ্জল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিপরীতে যতই আমরা এগুলোকে কিছু সংখ্যক সাম্প্রদায়িক, ধান্দাবাজ, ও ইতর প্রাণীর কাজ মনে করে সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করি, বিষয়টি মোটেই সেখানে সীমাবদ্ধ নেই। রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে সাম্প্রদায়িকতার চর্চা অব্যাহত থাকায় আমাদের সমাজ মানসে ইসলাম ও মুসলমান ব্যতীত অন্যান্য ধর্ম ও ধর্মানুসারীর অস্তিত্ব সীমিত হয়ে পড়েছে। এককালে যে সকল চিন্তা ও আচরণ প্রবল আপত্তিকর বিবেচিত হতো, সেসব আজ ধীরে ধীরে রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরে স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যাচ্ছে। ফলে হিন্দু বা অন্য কোন অমুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কোন উগ্রবাদীর সস্তা বয়ানের সাথে কোন নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রগতিশীল’ অধ্যাপকের শব্দচয়নে পার্থক্য থাকছে না।
বিগত বছরগুলোতে ইসলাম অবমাননার ছুতোয় বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সংখ্যালঘু শিক্ষক-শিক্ষার্থী নানাভাবে অপদস্থ হয়েছেন। শিক্ষকগণ বহু ক্ষেত্রে নিগৃহীত হয়ে চাকরি হারিয়েছেন অথবা নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। বহু ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ছাত্রত্ব বাতিল হয়েছে, এখনো অনেকে কারা অন্তরালে। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে তো ধর্ম অবমাননার প্রসঙ্গ আনাটাই বাহুল্য। বিগত এক দশকে সারাদেশে অসংখ্য সাম্প্রদায়িক নির্যাতন , লুটপাট ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে শুধুমাত্র ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অজুহাতে। প্রায় প্রতিটি ঘটনায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, জনপ্রতিনিধি, পুলিশ ও সরকারি প্রশাসন অতি সক্রিয় হয়ে ‘আশু’ বিচারের ব্যবস্থা করেছেন। প্রত্যেকটি ঘটনায় পরে প্রমাণিত হয়েছে যে কাউকে পরিকল্পিত উপায়ে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ফাঁসানোর জন্যই তার ফেসবুক হ্যাক করে ফটোশপকৃত ছবি বা উস্কানিমূলক বক্তব্য পোস্ট করা হয়েছিল। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বা কিছু ক্ষেত্রে মামলা হওয়ার আগেই পুলিশ তথাকথিত অভিযুক্ত সংখ্যালঘুকে গ্রেফতার করেন এবং স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। এসব হামলার ঘটনায় আক্রান্ত ও নির্যাতিত সংখ্যালঘুরা সাহস করে যদি মামলা করেনও, কিছুদিনের মধ্যে সমস্ত আসামীর জামিন হয়ে যায়। জেলে পচে মরেন সেই নির্যাতিত সংখ্যালঘু, যিনি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন বলে ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে।
উল্টোদিকে বাংলাদেশে হিন্দু বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্ম অবমাননার জন্য মামলা হয়েছে এমন ঘটনা বিরল। সমীকরণ অত্যন্ত সহজ - মামলা যেহেতু হয় না, সুতরাং ধরে নিতে হবে তাদের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি অবমাননার কোন ঘটনাই ঘটে না, অথবা তাদের ধর্মীয় চেতনাই নেই। ধর্মীয় চেতনার মতই বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননার ঘটনা বা মামলাও প্রায় একপাক্ষিক। গত এক দশকে ঘটে যাওয়া অসংখ্য সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের মামলায় একটিতেও ন্যায়বিচার পাওয়া যায়নি। এক্ষেত্রে অনেকদিন থেকেই আমরা প্রায় পাকিস্তানের সমকক্ষ।
এক দশকের বেশি সময় একটানা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। অথচ এই সময়কালেই নিয়মিত বিরতিতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে । একজন চিত্রনায়িকার ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টায় অভিযুক্তকে রক্ষার জন্য জাতীয় সংসদ উত্তপ্ত হতে পারে, কিন্তু দুই কোটির বেশি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জীবন, মান ও সম্পদের উপর ক্রমাগত আঘাত ও নির্যাতন বিষয়ে কেউ কোনদিন টু শব্দটি করতে সাহস করে না। সংবিধানের ইসলামী চরিত্র অক্ষুন্ন রেখে প্রকারান্তরে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে অস্বীকার করা হয়েছে।
তো, ঐ অধ্যাপক কি ভুল করে ভগবানকে মদ্যপ বানিয়েছেন? তিনি কি পুরো গল্পে শূধু এই একটিমাত্র শব্দ বদলে তাঁর আরাধ্য 'আল্লাহ' কথাটি বসাতে পারতেন? ব্যক্তিজীবনে তিনি তো সৃষ্টিকর্তাকে ‘ভগবান’ অভিধায় সম্বোধন করেন না, তাহলে তাঁকে নিয়ে তামাশা করার সময়েই কেন শুধু ভগবানকে দরকার হয়? তিনি কি তাহলে নিশ্চিত ছিলেন যে ভগবান বা ঈশ্বরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা হাস্য রসিকতা শতভাগ নিরাপদ? সত্যিই তো! এসব করে কবে কার নখ কাটা গেছে? তাঁকে আর আলাদা করে দোষ দিই কী করে? এ দেশের জল-হাওয়াই হয়তো তাঁকে এমন করে ভাবতে শিখিয়েছে। প্রাণের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পচন দেখে এদেশের লাখো মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়-এই যা!
দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের এই মহান অধ্যাপক শেষ পর্যন্ত জানিয়েছেন, তিনি জানতেনই না যে এরকম একটি সাধারন কথায় কারো ধর্মীয় চেতনা ক্ষুন্ন হতে পারে। আহা! এই না হলে আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতিঘর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান শিক্ষাগুরু!
গোবিন্দ মন্ডল
অধ্যাপক (আইন বিভাগ)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Editor & Publisher : Sukriti Mondal.
E-mail: eibelanews2022@gmail.com