নতুন পোশাকে আমার নিজের কাছেই নিজেকে হিরো হিরো মনে হচ্ছে। পরের দিন কলেজে গেলাম, অনেক বন্ধু-বান্ধব জুটে গেছে এরমধ্যে আমার। আমার কথা বলার ধরনে একটু নতুনত্বের ছোঁয়া লেগেছে, নতুন পোশাক পরিধানের জন্য এমন হলো কি না বুঝে উঠতে পারছিনা। তবে এটা সত্যি, ভালো একটি পোশাক যেন একজন মানুষকে স্মার্ট করে তোলে, আমার ক্ষেত্রে এর একটুও ব্যতিক্রম হলো না। আস্তে আস্তে আমি কলেজে ও কলেজের বাইরের অভিজাত শ্রেণী বন্ধুদের সাথে মিশতে শুরু করলাম। ইতিমধ্যে অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। কোতোয়ালি থানার ওসি মোস্তফা কবির ইতিমধ্যে দুই তিন দিন থানায় ডেকেছে আমায়। দুই তিন দিন থানায় যাওয়াতে আমার ভয়-ভীতি কেটে গেছে। ওসি মোস্তফা কবির এর পরিবারের সাথেও আমার অনেক আন্তরিকতার সম্পর্ক তৈরি হতে থাকলো। তার মিসেস আমাকে তার ছোট ভাইয়ের মতো ট্রিট করা শুরু করলো। ওসি সাহেব তার দুটি ছেলেকে প্রাইভেট পড়ানোর দায়িত্ব দিলো আমাকে। আমাকে আরো বলল, তোমার কোন আর্থিক সমস্যা হলে আমাকে জানিও। ওসি সাহেবের এই কথায় আমার আত্মবিশ্বাস ফিরে আসতে লাগলো। এদিকে আমাকে লজিং মাস্টার থাকার জন্য অরুণ সাহার বাড়ী থেকে প্রস্তাব দিলো। অরুণ সাহা গোয়ালচামট এলাকার মধ্যে ধনী মানুষ, অর্থ বিত্ত সন্মান প্রতিপত্তির দিক অরুণ সাহার থেকে ওই গোয়ালচামট এলাকায় আর কেউ নেই। লজিং মাস্টার থাকার জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্হা আছে অরুণ সাহার বাড়িতে। উনার ছেলে মানিক মেয়ে হীরা ওদের পড়াতে হবে, রাজি হয়ে অরুণ সাহার বাড়িতে লজিং মাস্টার হিসেবে উঠে গেলাম, ভালোই চলছে এখানে আমার। অরুন সাহা উনাকে আমি মেঝদা বলে সন্মোধন করলাম, উনার বৌকে মেঝ বৌদি বলে সন্মোধন করলাম। আর উনার ছোট ভাই গৌড় দাকে ছোট'দা বলে এবং তার বৌকে ছোট বৌদি বলে সন্মোধন করলাম। এখানে মেঝো বৌদি আমাকে অনেক স্নেহ করেন। ছোট'দার মেয়ে চিত্রা ওকেও পড়তে হতো, খারাপ চলছে না এখানে সব মিলিয়ে। মেঝদার বড় ছেলে অরুপ, মেঝো ছেলে অসিত, অরুপ আমার বন্ধুর মত হয়ে গেলো, অরুপ একটু মস্তান টাইপের ছেলে, খালি মারামারি সাথে যুক্ত হয়ে যায়, সবাই ভয়ও পায় ওকে দেখে। মেঝদার একটি মটরসাইকেল ছিলো। অসিত আমাকে মটরসাইকেল চালানো শিখিয়ে দিলো। আমি খুব সহজেই মটরসাইকেল চালানো শিখে ফেললাম। মাঝে মধ্যেই মেঝদার মটরসাইকেল নিয়ে কলেজে চলে যেতাম। সব কিছু মিলিয়ে খারাপ চলছেনা আমার তবে ভালো সময় গুলো অতি দ্রুতো চলে যায়।
ইতিমধ্যে থানার ওসি সাহেবের সাথে আমার আন্তরিকতা আরো বাড়তে থাকলো। উনার ছেলে দুইজন জেলা স্কুলে পড়ে, সপ্তাহে চার দিন যেতে হয় ওদের ওখানে, ওদের পড়াতে আমার খুব ভালো লাগে। ওসি'র সাথে সম্পর্ক ভালো হওয়ার কারনে অনেক পুলিশের লোকও আমার সাথে ভাল ব্যবহার করে। ওসি'র পৈত্রিক বাড়ী ঢাকার রায়ের বাজারে। ঐ রায়ের বাজার থেকে কেউ আসলেই আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে ওসি'র মধ্যে একটি হৃদয়বান মানুষের মহানুভবতার লক্ষণ উপলব্ধি করলাম আমি। সময়ের সাথে সম্পর্ক এমন এক পর্যায়ে গেলো, মাঝে মাঝে উনার ব্যবহৃত ২০০ সিসি মটরসাইকেলও আমাকে দিতো। মটরসাইকেল'টি আমার এতো ভালো লাগতো বলে বুঝানো যাবে না। ওসি সাহেবের মহানুভবতায় আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম আর ভাবতে থাকলাম- মানুষ মানুষের জন্য, মানুষের বিপদের সময় পাশে থেকে সহযোগিতা করাই মানুষের ধর্ম। তাই মানুষ বিপদে-আপদে, সমস্যা-সংকটে ছুটে এসে মানুষকে সাহায্য করবে, এমন প্রত্যাশা মানুষ মাত্রই করতে পারে। মানব জীবনের সম্পূর্ণতা আর তৃপ্তির জন্য সমাজের অসহায়-দুঃখী মানুষদের জন্য কিছু করার আমাদের সবারই সুযোগ রয়েছে, মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার। আলোকিত জীবন গড়তে হলে শিক্ষার প্রয়োজন, শিক্ষাগুরুরা সব সময় বলতেন মানুষ মানুষের জন্য। আরো বলতেন এই পৃথিবীর মধ্যে সব চাইতে বড় আদালত মানুষের বিবেক। সমাজে কিছু মানুষ আছেন যারা স্বপ্ন দেখেন মানুষের কল্যাণে কাজ করার জন্য। মানুষের জন্য মানবতা, মানবতার জন্যই মানুষ, অসহায় এবং বঞ্চিত মানুষের উপকারে নিজেকে আত্মনিবেদন করার এবং অন্যকে এতে উৎসাহিত করা। শত শত বছর ধরে মানুষের জীবন পাল্টে দেওয়া থেকে শুরু করে জীবনের নতুন অর্থ নির্মাণের ক্ষেত্রে এই ধরনের মানুষের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। অনেক বছর বাঁচলেই কেবল বড় মানুষ হওয়া যায় না। একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে যদি একজন মানুষ সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখে, তাতেই হয়তো জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। ওসি মোস্তফা কবির এমন একজন মানুষ যে কি-না তার গ্রামে একটি এতিমখানা পরিচালনা করে। আমার মতো অনেক গরীব দুঃখী মানুষের ছেলে মেয়েরা সেখানে পড়াশোনা করে, কিছু এতিম বাচ্চা আছে যাদের কথা ভাবতে তার মন খারাপ হয়, ওসি সাহেব বড় ভালো মানুষ। উনার সাথে কথা বলে আমার অনেক ভালো লাগে, ওসি সাহেবের কথা থেকে জীবনের অনেক কিছু শেখার বাকি আমার, তাই উনি যখন কথা বলে আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকি।
ভালো সময়গুলো কেন যেন দ্রুততার সাথে চলে যায়। শুধু থেকে যায় আমার হারিয়ে যাওয়া দিন গুলো কথা। ইতিমধ্যে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু যারা প্রতিনিয়তই এক সাথে চলি। অজয়-জীবন-বাবুল যেন এক আত্মার আত্মীয়, সবাই একে অপরের পরিপূরক। কলেজে যাওয়া থেকে শুরু করে সব কাজে একসাথে আমরা করতে থাকি। একদিন এক ঘটনা ঘটে গেলো, আমি আর অজয় রিক্সায় গোয়ালচামট যাচ্ছিলাম। রিক্সাওয়াল বাজে একটি মন্তব্য করছে অজয়কে, ওতো রেগে রিক্সাওয়ালাকে মাইর দিয়ে দিলো, অজয় একটু নেতা কিসিমের তাই ধৈর্য শক্তি একটু কম। কে জানে ঐ রিক্সাওয়ালা ফরিদপুরের টপ টেরর বাবু কসাই এর শশুর। রিক্সাওয়ালা তো যথারীতি বাবু কসাইকে সব ঘটনা বলে দিছে, বাবু কসাইতো রেগে ফায়ার। বাবু কসাইতো ওর চেলা বেলাকে বলে দিসে অজয় ও জীবন'কে যেখানে যেখানে পাবি ধরে নিয়ে আসবি। আমি ঘটনাটা শুনলাম তাই চুপি চুপি একা চলে গেলাম বাবু কসাই এর কাছে। বাবু কসাই আমাকে নামে চেনে ওই হাত দেখার সুবাদে। মনে মনে সে নাকি আমাকেই খুজছে হাত দেখানোর জন্য। হাত দেখার পর খুব খুশিই হলো। পরে আমি তাকে তার শশুরের ঘটনা বললাম। প্রথমে রাগ করলো পরে ঠান্ডা হয়ে গেলো। পরের দিন কলেজে পরিচয় হলো পিয়াসা আপার সাথে, আজিজ মেডিসিন কর্নার এর মালিকের মেয়ে, সে আমাকে জোর করে তাদের বাসায় নিয়ে গেল হাত দেখতে হবে বলে, তার বড় ভাই মেজর, বিপাসা আপা বড় বোন, তৃষা ছোট বোন এবং বাপ্পি নামেও একটা ভাই আছে। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো আমায় পরে আমি সবার হাত দেখলাম, সবার হাত দেখার পর্ব শেষ করে টিউশনি করতে চলে গেলাম। এদিকে আমার পড়াশুনার চাপও বাড়ছে। হটাৎ করে ডাক পাঠালো আলীপুরের রাজু ভাই, আমি তার লোকের সাথে সাথে গেলাম আলীপুর হাত দেখতে বললো। রাজু ভাইয়ের হাত দেখতে আমার বিবেক সায় দিচ্ছে না, কি যেন এক অজানা অস্বস্তি বোধ করছি, খারাপ লাগছে আমার। জানি না তার কারন কি? অস্বস্তি এবং বিষন্নতায় তার হাত ধরে নেওয়ার সাথে সাথে আমার শরীরে একটা বিদ্যুৎ চমকালো, বলতে থাকলাম তার কথা, শেষ কথা মুখ দিয়ে বের হয়ে গেলো- রাজু ভাই ৭২ ঘন্টার মধ্যে চরম বিপদের আশঙ্কা আছে আপনার। একথা বলা মাত্রই আমার অসস্তি যেনো আরো বেড়ে গেলো, শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে আমার কষ্ট হচ্ছে অনেক। হটাৎ করে কি যেন আচমকা একটি বাতাস আমার বুক থেকে বেড়িয়ে গেলো, আমি কষ্ট পেলাম বেশ। আমি জানি না কি ভাবে আমি বাসায় ফিরলাম, বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে ছিলাম নাকি এক দিন এক রাত। সন্ধ্যায় যখন আমার ঘুম ভাঙ্গল আরুপ বলছে আলীপুরের রাজু ভাই খুন হয়েছে। আমি অপলক দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে অরুপের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, এরপর আর কখনই হাত দেখা হয়নি আমার...। চলবে...
নি এম/
Editor & Publisher : Sukriti Mondal.
E-mail: eibelanews2022@gmail.com