পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে প্রথম হিন্দু মন্দির নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যদিও এ মন্দির নির্মাণের জন্য সরকারই অনুদান দিয়েছিল। কিন্তু ইসলামি সংগঠনের ফতোয়া জারির পর পিছু হটেছে ইমরান সরকার। এই মাসের শুরুতে ইসলামাবাদের প্রথম হিন্দু মন্দিরের কাজ শুরু হওয়ার পরে অনেক পাকিস্তানি তাদের সরকারকে সহিংসতার হুমকি দিচ্ছে এবং হিন্দুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করছে।
মন্দির নির্মাণ বন্ধে আদালতে পিটিশন দাখিলও করা হয়েছে।
দ্য গার্ডিয়ান জানায়, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফের জোটসঙ্গী পাকিস্তান মুসলিম লিগ– কায়েদ (পিএমএল-কিউ) ‘মন্দির নির্মাণ ইসলামি আদর্শের পরিপন্থী’ বলে বিরোধিতা করে।
এর আগে লাহোরভিত্তিক ইসলামি সংগঠন জামিয়া আশরাফিয়া হিন্দু মন্দির নির্মাণের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে।
পাকিস্তানি হিন্দুদের ‘হিন্দুস্তানী কূটন’ বলে উল্লেখ করা একটি নতুন ঘৃণার গান সোশ্যাল মিডিয়ায় প্লাবিত হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাকিস্তানি গায়কের মিউজিক ভিডিওতে দেশটির সেনাবাহিনীর ফুটেজ দেখানো হয়েছে এবং হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সীমানায় থাকতে হুমকি দেয়া হয়েছে।
গত সপ্তাহে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দ্বারা ইসলামাবাদের এইচ ৯ সেক্টরে একটি শ্রীকৃষ্ণ মন্দির নির্মাণ বন্ধ করার ঘটনাটি পাকিস্তানে ধর্মীয় স্বাধীনতা কতটা সঙ্কুচিত তার একটি বড় প্রমাণ। এই মন্দিরটি রাজধানীতে বসবাসকারী হিন্দুদের জন্য প্রথম উপাসনাস্থান হতো, কিন্তু আর নয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০ হাজার বর্গফুটের ওই শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরে একটি শ্মশান ও কমিউনিটি হল নির্মাণের কথা ছিল। ইসলামাবাদের হিন্দুরা দীর্ঘদিন ধরেই সরকারের কাছে উপাসনার জন্য একটি মন্দির ও শ্মশানের জন্য জায়গা চেয়ে আসছিলেন।
ফতোয়া, ধর্মীয় গোড়ামি, হুমকি এবং রাজনৈতিক পয়েন্ট স্কোরিং এর দ্বারা ইসলামপন্থীরা হিন্দু মন্দিরের ইস্যুটিকে নতুন বিরোধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ৫ জুলাই ইসলামাবাদে স্থানীয় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ মন্দিরের জন্য বরাদ্দকৃত প্লটে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ বন্ধ করে দেয়।
দ্যা নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র মাজহার হুসেনের মতে, কর্তৃপক্ষের কাছে কোন বিল্ডিং নকশা জমা দেয়া হয়নি বলে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভাবে যেকোন নির্মাণ কাজের জন্য ইসলামাবাদে তার বিল্ডিং নকশা অনুমোদন হওয়া দরকার।
২০১৮ সালে পাকিস্তানের প্রাক্তন সরকার যখন মন্দিরের জন্য জমি বরাদ্দ করেছিল, তখন মুসলিম বিক্ষোভকারীরা দ্রুতই এই প্লটটিতে শিবির স্থাপন করেছিল এবং ইসলামাবাদে হিন্দু স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দিতে অস্বীকার করেছিল বলে জানায় নিউ ইয়র্ক টাইমস। তবে মন্দিরের উকিলরা এটিকে বিজয় ভেবেছিল এবং গত মাসে মন্দিরের প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। এর কয়েকদিন পরে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান মন্দিরের নির্মাণ কাজের জন্য সরকারকে প্রায় ১.৩ মিলিয়ন ডলার সরবরাহের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা প্রয়োজনের প্রায় পঞ্চমাংশ।
যাই হোক, মুসলিম আলেমরা আবার পদক্ষেপ নিলেন এবং বিষয়গুলি পরিবর্তন হতে শুরু করে। একাধিক আলেম মত দিয়েছিলেন, কোন হিন্দু মন্দির স্থাপন উচিত নয় কারণ পাকিস্তান একটি মুসলিম দেশ। নাগরিকরা মন্দিরের তহবিল সরবরাহ করার জন্য সরকারের নিন্দা জানিয়েছিলেন। মিডিয়া আউটলেটগুলি মন্দির নির্মাণ বন্ধে প্রকাশ্যে প্রচারণা চালিয়েছে।
চূড়ান্ত চাপের মধ্য দিয়ে সরকার এই মাসের শুরুতে মন্দিরটি নির্মাণের জন্য অর্থ অনুদানের প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি থেকে পেছনে ফিরেছিল, অনুদান দেবে কিনা তা নিয়ে ইসলামিক আদর্শিক কাউন্সিলরের দিকনির্দেশনা চেয়েছিল। গত রবিবার ইস্যুটি নিয়ে সহিংসতা আরো উচ্চতায় পৌঁছে যখন একদল পুরুষ মন্দিরের জমির চারপাশে আংশিকভাবে নির্মিত প্রাচীর ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।
দাবি করা হয় যে, এটি তাদের ইসলামিক দায়িত্ব। তারা আনন্দের সাথে তাদের এই কার্যক্রম ভিডিও রেকর্ড করে এবং তা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনো তাদের কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।
২০১৮ সালে ইমরান খান নির্বাচনে জয়লাভ করার সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সকল ধর্মের সহাবস্থানের। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ভারতের প্রথম মন্দিরের নির্মাণ কাজ বন্ধ হওয়ায় সে সকল আশা র্ব্যথতায় পর্যবসিত হয়েছে। এখন অব্দি অনুপ্রবেশকারীরা মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর ভাঙচুর, শ্লোগান দেয়া এবং সেখানে নামায পড়া ও তার ভিডিও পোস্ট অব্যাহত রেখেছে। এই অবস্থায় রাজধানীতে হিন্দু সম্প্রদায় শঙ্কিত এবং অসহায় বোধ করছে। ইমরান খান তার নির্বাচনী প্রচারণায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের অবস্থার উন্নতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং খুবই কম প্রতিক্রিয়া সহ ইসলামী মৌলবাদীদের টার্গেট করেছিলেন। তিনি তাদের উপাসনাস্থান পুনরুদ্ধার করার শপথ নিয়েছিলেন।
গত বছরের শেষের দিকে যখন ইমরান খান গুরুদ্বুয়ারে ৫০০ বছরের পুরনো শিখ মন্দিরটি চালু করেছিলেন তখন তার প্রতিশ্রুতি কার্যকর হয়েছে বলে মনে হয়েছিল। তবে রাজধানীতে হিন্দু মন্দির নির্মাণের ব্যর্থতা তার প্রচেস্টাকে ব্যর্থ করেছে। যদিও হিন্দুরা পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার দুই থেকে চার শতাংশ, তবু তাদের উপাসনার কোন মন্দির নেই। যদি তাদের কেউ মারা যায় তাহলে ঐতিহ্য মোতাবেক সৎকার করতে তাদের বহু দূরের পথ পাড়ি দিয়ে শ্মশানে যেতে হয়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ইসলামাবাদের কোনো হিন্দু মন্দির গড়ে ওঠেনি। ২০১৭ সালে এ মন্দির নির্মাণের অনুমোদন দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা দীর্ঘসূত্রিতার মুখে পড়ে।
সংখ্যালঘুদের প্রতি পাকিস্তানের বিরুপ পক্ষপাতিত্ব রাতারাতি প্রকাশ পায়নি। নিশ্চয়, আহমদীয়া এবং বেলুচিরা সহ সংখ্যালঘুদের কয়েক দশক জাতীয়করণ এই পক্ষপাতিত্বের মূলে রয়েছে।
নি এম/
Editor & Publisher : Sukriti Mondal.
E-mail: eibelanews2022@gmail.com