ঘরে, পরিবারে আর সমাজে সবাই আমরা দুর্গা খুঁজি। দুর্গার দশভূজা রূপ, অর্থাত দশ হাতে সব করার সক্ষমতা নিয়ে আমরা আপ্লুত। আমরা চাই ঘরে ঘরে মেয়েরা একাই বাড়ির সব কাজ সেরে ফেলবে। সে এক হাতে কোন সাহায্য ছাড়াই স্বামী সেবা করবে, শ্বশুর শাশুড়িসহ সকলের দায়িত্ব পালন করবে, সন্তান লালন পালন করবে, ঘর বাড়ি পরস্কার পরিচ্ছন্ন রাখবে। আবার সে রূপে এবং পোষাকেও হবে দেবীর মত নিখুঁত সুন্দর। দয়ালু হবে, সকলের তরে এগিয়ে যাবে সর্বদা। তবে, দুর্গা দেবীর থেকে মানবী দুর্গার সবচেয়ে বড় তফাত হবে, সে কখনো তার স্তুতি চাইবেনা। মানে, সে আর সব দশভূজা দেবী দুর্গার মত করবে বটে, কিন্তু কেউ যেমন তার কাজের ভার ভাগ করতে চাইবেনা আবার সে কিভাবে এত কাজ করার শক্তি আর সক্ষমতাধারী অনন্যসাধারণ হয়ে উঠল তা নিয়ে কেউ কখনো প্রশংসাবাক্যও উচ্চারণ করবেনা। নারীর প্রতি এমন সীমাহীন প্রত্যাশা বাঙ্গালীর বহু শত বছরের এই দশভূজা দেবী ভজনার ফল কিনা, তা নিয়ে বোধহয় ভাবনার অবকাশ আছে।
দেবী ভজনার সূত্রেই বোধহয় বাঙ্গালী অন্য অনেক জাতি গোষ্ঠীর মত নারীর বাড়ি থেকে বের হওয়ার পথে তত বাধা নয়। তবে, সেসময় তাঁকেই নানা বয়সের তিন চার সন্তান কোলে কাঁধে নিয়ে বোচকা, বস্তা বেঁধে বের হতে হবে। দেবী শক্তির ধারণার বোধেই বোধহয় বাঙ্গালী পুরুষ সামনে গটগট করে হাঁটেন আর কোলে সন্তান নিয়ে ও কাঁধে সংসারের লটবহর নিয়ে, তারপর আরেক হাতে আরো এক দুইজন শিশুর হাত ধরে বেশ পেছনে হাঁটেন মা – আমাদের পরিবারের নারী শক্তি। আর আমরা শুনি পরিবারের প্রধান পুরুষটি গতি না কমিয়ে হাঁটছেন, গজগজ করছেন আর মাঝে মাঝে মাথা ঘুরিয়ে জোরে হাঁটার তাড়া দিচ্ছেন বটে কিন্তু একটু পেছনে হেঁটে এসে বা গতি কমিয়ে কোন দায় ভাগ করে নিচ্ছেননা।
এই যে সব শ্রম, কাজ আর ভার দিলেন নারীর কাঁধে কিন্তু তার শক্তির সঙ্গে নিজের শক্তি মেলালেননা, তাহলে কী দেবী দুর্গার বোধন হয় সংসারে? তবে কী সন্তানেরা ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষী, বিদ্যার দেবী সরস্বতী, বীর কার্তিক আর সিদ্ধিদাতা গণেশ হয়ে উঠতে পারে? বাংলার প্রচলিত প্রবাদেই তো আছে, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে, গুণবান পতি যদি থাকে তাঁর সনে’।
মহিষাসুর যখন এতই পরাক্রমশালী হয়ে উঠলো যে দেবতাদেরকেই স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার উপক্রম করলো তখন শুধু দুর্গার ‘গুণবান পতি’ শিবই নয়, সকল দেবতারাই এগিয়ে এলেন তাদের নানান শক্তি উপহার দিয়ে দুর্গাকে অব্যর্থ করে তুলতে। এ থেকে কী ভাবার অবকাশ আছে যে, এই মর্ত্যলোক, আমার আপনার সংসার, বাস্তবতা, প্রতিদিনের জীবনটাও আসলে এরই প্রতিচ্ছবি? অসুর বিনাশ বা অপশক্তি দমনের উপায় নারী বা প্রান্তিক মানুষকে পিছে ফেলে রাখা নয়, বরং ভীষণভাবে একের শক্তিতে অন্যের উন্মেষের সুযোগ তৈরি করা। খুন ধর্ষনের বিচার বা সংসারে, গণপরিসরে নারীর নিগ্রহ নির্যাতনে হঠাৎ সোচ্চার হয়ে ফাঁসি চাই, ক্রসফায়ার চাই বলে অন্ধ আক্রোশে ফুঁসে না উঠে শিবেদের প্রয়োজন দুর্গার হাত ধরা। দেবীর পাশে হাঁটতে হবে দেবকে, তবেই না মর্ত্যলোক পরিণত হবে স্বর্গধামে।
দুর্গা পুজার সময়টায় দেবী আসেন তারঁ স্বামী মহাদেবের বাড়ি স্বর্গপুর কৈলাশ থেকে এই নশ্বর পৃথিবীতে, তাঁর বাপের বাড়িতে। দেবীর নিজের বাড়ি তবে কই? দেবীর উপায় নাই, একদিনও বেশি থাকবেন, তাই ‘আসছে বছর আবার হবে’ বলে বোঁচকা পত্তর বেঁধে একেবারে নির্ধারিত সময়েই বাপের বাড়ির মানুষ চোখের জলে মেয়েকে ‘বিসর্জন’ দিয়ে দেন। আমাদের এই সমাজে, বাঙ্গালীর এই দেশে মানবীরও তো নিজের বাড়ি নাই; বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি ঘুরে মর, সেখানেই ঠিকাানা খোঁজ, গায়ে খেটে কোনমতে বিনা আওয়াজে সামান্য ঠাঁই করে নাও, নইলে জলে ডুবে মর- সেখানেই কী লোকাচারে সার্বজনীন হয়ে ওঠা বাঙ্গালীর দূর্গাও ‘শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’ দেবী থেকে শেষ পর্যন্ত নিরুপায় মানবী হয়ে ওঠেন! স্বর্গলোক মর্ত্যলোক সবের অধিকারী থাকেন কেবল দেব আর মানবেরাই!
আজ এই পরিসরে আর আলোচনায় অগ্রসর হওয়ার উপায় নাই, তবে সমাজ মানসের প্রতিচ্ছবি কীভাবে দেবীর ভজনা থেকে মানবীর কাছে প্রত্যাশায় পড়ে আর মানবীকে কল্পনার মানসের ছাপ কীভাবে পড়ে দেবীকে উপাসনায় তা নিয়ে বিস্তর আলাপের সুযোগ কিন্তু আছে নিজেদের মনোজগত পাঠেই। যে কারণে, অনেক গবেষক বলছেন, হাজার হাজার বছর ধরে ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল বা উত্তর পূর্ব এশিয়াতেও সকল দেবশক্তির আধার যে সিংহবাহিনী দেবী বা মাতৃমূর্তির পূজা হয়েছে সেখানে দেবী অসুরবিনাশী ছিলেন বটে, তবে কোথাও রণরঙ্গিনী দেবীর সঙ্গে চার সন্তান জুড়ে দেওয়া হয়নি। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নলিনীকান্ত ভট্টশালী থেকে এনামুল হকের মতো ইতিহাসবিদেরা অনেক চেষ্টা করেও চার ছেলেমেয়ে সহ দুর্গার কোন প্রাচীন ভাস্কর্য খুঁজে পাননি।
তার মানে,সন্তানের লালন, আর্তের সেবা থেকে দুর্জনের আমূল বিনাশ সব দায়িত্ব দুর্গতিনাশিনী দূর্গার দশহাতে দিয়ে আনন্দে মেতেছে বাঙ্গালী। ইতিহাসবিদেরা বলেন, সেই সিন্ধু সভ্যতা থেকে বহুভূজা দেবীর যত মুর্তির খোজ মিলেছে, বাঙ্গালী ছাড়া কেউই দেবীকে দেয়নি দশহাতও। শক্তিময়ী, অস্ত্রধারী ও জগদ্ধাত্রী দেবীকে কন্যারূপে ও মাতৃরূপে কল্পনা করা একমাত্র বাঙ্গালীর দূর্গারই অনন্য বৈশিষ্ট্য বটে। দশহাতে মুখ বুজে খেটে ঘরে ঘরে দূর্গার অনেক উদাহরণ তো তৈরি হল, এবার ঘরে ঘরে মাতৃরূপেণ সংস্থিতা দেবীর শক্তিরূপের বোধন হোক। অসুরের বিনাশে দেব আর দেবীদের শক্তির সম্মিলিত প্রকাশ ঘটুক আমাদের জগত সংসারে। শুধু দেবীমূর্তির মধ্যে নয় মূর্তিমান মানবীর ভেতরকার শক্তিমান রূপের, অসুরবিনাশী ভূমিকার ভজনা হোক এই সমাজে।
নি এম/
Editor & Publisher : Sukriti Mondal.
E-mail: eibelanews2022@gmail.com