০১ জুলাই ১৯২১ খ্রীস্টাব্দে প্রতিষ্ঠালাভ করে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামে খ্যাত 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়'। সে হিসেবে শতবর্ষ পূর্ণ করেছে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষার মান, আবাসন ব্যবস্থা ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে বৃটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তুল্যতা। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার শর্ত বা বৈশিষ্ট্যের কারণেই এমনটি ঘটেছে। যেসব বৈশিষ্ট্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় সেসবের মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে “Unitary, teaching and residential"। দৃশ্যমান যে, এই বৈশিষ্ট্যের অন্যতম মূল উপাদান হচ্ছে “residential", অর্থাৎ এই বিশ্ববিদ্যালয় হবে সম্পূর্ণ আবাসিক। তাই ১৯২১ সালের ১ জুলাই প্রতিষ্ঠালগ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি আবাসকি হল নিয়ে যাত্রা শুরু করে। হল তিনটি হচ্ছে- ঢাকা হল (বর্তমানে শহীদুল্লাহ্ হল), জগন্নাথ হল এবং মুসলিম হল (বর্তমানে সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হল)। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে এই তিনটি ছাত্রাবাসি শতবর্ষ পূর্ণতা পেলো। তবে বক্ষমান প্রবন্ধে জগন্নাথ হলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনায় প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
জগন্নাথ হলের মানকরণে বিশেষ স্বকীয়তা বিদ্যমান। কারণ এই নামকরণের সাথে বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ জগন্নাথ কলেজের (পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত) সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ঢাকার বালিয়াটির জমিদার মহানুভব কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর দানে তাঁর পিতার নামে ১৮৮৪ সালে জগন্নাথ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’টি Feeder College-এর একটি ছিল এই জগন্নাথ কলেজ, অন্যটি ঢাকা কলেজ। উল্লেখ্য, মূলত ঢাকা কলেজ এবং জগন্নাথ কলেজের Post Intermediate শ্রেণীর ছাত্রদেরকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্ল্যাস শুরু হয়। তাই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নবপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে কলেজ দু’টি আত্মীভূত হয়ে যায়। এরই স্বীকৃতি স্বরূপ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশক্রমে কলেজ দু’টির নামের আদলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’টি হলের নামকরণ করা হয়, যথা- ‘ঢাকা হল’ এবং ‘জগন্নাথ হল’। উল্লেখ্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যাবতীয় পরিকল্পনা এবং সুপারিশমালা প্রণয়ন করে। উক্ত কমিশন আরো সুপারিশ করে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শ্রেণীর ৩০০ থেকে ৪০০ ছাত্রের আবাসিক, খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা ও বিনোদনের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধাসহ সার্বক্ষণিক শিক্ষা-নির্দেশনার ব্যবস্থা থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক হলে একজন অভিজ্ঞ অধ্যাপককে প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে নিয়োগদান করবেন। অক্সফোর্ড ও কেম্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজগুলোর প্রধানের ন্যায় তাঁর পদবি হবে Provost, বাংলায় প্রাধ্যক্ষ। পদগতভাবে তিনি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মর্যাদা ভোগ করবেন, হবেন আদর্শবান এবং হল-প্রশাসনে থাকবে তাঁর সর্বময় নিয়ন্ত্রণ। তাঁর নির্দেশনা এবং অনুকরণে হলের ছাত্রদের চরিত্র রূপায়িত হবে। প্রভোস্টকে সহায়তাদানে প্রতি ৭৫ জন ছাত্রের জন্য একজন করে হাউজ টিউটর নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। হলগুলোর ধর্মীয়-সম্প্রদায়ভিত্তিক আবাসিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কমিশন সারা ভারতের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানসহ গণ্যমান্য বহু হিন্দু, মুসলমান এবং ইংরেজ ব্যক্তিবর্গের সাক্ষ্য গ্রহণ করে। এসব সাক্ষাতকার ও কমিশনের স্বীয় বিবেচনার আলোকে পাঠ্য বিষয় এবং ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায়ের আলোকে সাধারণত কলা অনুষদ ও আইন বিভাগের অমুসলমান ছাত্রদের জন্য জগন্নাথ হল, বিজ্ঞান বিভাগগুলোর ছাত্রদের জন্য ঢাকা হল এবং মুসলমান ছাত্রদের জন্য মুসলিম হল ছাত্রাবাস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। তবে কালের পরিক্রমায় জগন্নাথ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগের অমুসলমান ছাত্রদের ছাত্রাবাসের রূপ পরিগ্রহ করে, যা অদ্যাবধি বিদ্যমান রয়েছে।
পরিপূর্ণ আবাসিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল এবং ক্ল্যাসরুমগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন গড়ার কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হবে বলে উপরোল্লিখিত কমিশন সুপারিশ করে। সুপারিশে আরো বলা হয়- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং শিক্ষকরা অভিন্ন কমিউনিটি গঠন করে একটি সাধারণ লক্ষ্য অর্জনে একে অন্যকে সহায়তা প্রদান করবেন। এর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এমন একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপদান করা হবে, যেখানে শুধু পুঁথিগত বিদ্যার্জন নয়, সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার মানসিক, শারীরিক, সাংস্কৃতিক এবং চারিত্রিক প্রশিক্ষণদানার্থে প্রকৃত শিক্ষাগ্রহণ ও চর্চার ব্যবস্থা থাকবে। এতদোদ্দেশ্যে প্রত্যেকটি হলে ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা রাখা হয়।
আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আদর্শ ছাত্রাবাস হিসেবে জগন্নাথ হলের প্রাথমিক অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য অভিক্ত বাংলা সরকার কর্তৃক একটি প্রকল্প প্রণীত হয়। এই প্রকল্পের আওতায় জগন্নাথ হলের জন্য ২৪৪৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৭৭ ফুট প্রস্থের একটি কেন্দ্রীয় ভবন, প্রতি ১০০ জন ছাত্রের জন্য রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত তিনটি ভবন এবং প্রভোস্ট ও হাউজ টিউটরদের জন্য আবাসিক ভবন অন্তর্ভূক্ত রাখা হয়। কেন্দ্রীয় ভবনটিতে ৪০০ জন লোক ধারণক্ষম ৭১৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৫০ ফুট প্রস্থের একটি অ্যাসেমব্লি হাউজ, ৪৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩০ ফুট প্রস্থের একটি কমনরুম, ২০৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২০ ফুট প্রস্থের একটি লাইব্রেরি, শিক্ষকদের জন্য ৩০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২০ ফুট প্রস্থের একটি কক্ষ এবং প্রভোস্ট ও তাঁর কারণিক সহকারীদের জন্য দুইটি অফিস কক্ষ অন্তর্ভূক্ত রাখা হয়। ছাত্রদের জন্য ২০৯ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৭২ ফুট প্রস্থের ইংরেজি E অক্ষরাকৃতির দ্বিতল বিশিষ্ট তিনটি ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। ছাত্রদের জন্য একটি ভবন এবং হাউজ টিউটরদের জন্য দুইটি ভবন বাদে জগন্নাথ হলের অন্য ভবনগুলোর নির্মাণ কাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর আগেই সষ্পন্ন হয়।
উপরোল্লিখিত জগন্নাথ হলের ভবনগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া প্রয়োজন। ১৯৮০ সাল-অবধি কেন্দ্রীয় ভবন বলতে অ্যাসেমব্লি হাউজ এবং ছাত্রদের জন্য নির্মিত ভবন দু’টি উত্তর বাড়ি ও দক্ষিণ বাড়ি নামে অবিহিত ছিল। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জগন্নাথ হলের সাথে সংশ্লিষ্ট শহীদ শিক্ষকদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ এরপর ভবনগুলোর নাম পরিবর্তন করে উত্তর বাড়ির নাম ‘গোবিন্দ চন্দ্র দেব ভবন’, দক্ষিণ বাড়ির নাম ‘জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা ভবন’ এবং অ্যাসেমব্লি হাউজের নাম ‘অনুদ্বৈপ্যায়ন ভট্টাচার্য ভবন’ রাখা হয়।
জগন্নাথ হলের আদি ভবন দু’টি (উত্তর বাড়ি ও দক্ষিণ বাড়ি) আদর্শ ছাত্রাবাস হিসেবে যাত্রা শুরু করে। দু’টি ভবনের সাথেই আলাদা কিচেন ও ডাইনিং হলের সুব্যবস্থা করা হয়। প্রতি ভবনের দ্বিতীয় তলার দুই কোণের বড় রুম দু’টি ছাত্রদের কমন রুম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সেখানে ছাত্রদের পত্র-পত্রিকা পড়া এবং অভ্যন্তরীণ ক্রীড়াদির ব্যবস্থা করা হয়। তাছাড়া ছাত্রদের স্নান করা ও সাঁতার কাটার জন্য এই দু’টি ভবনের ঠিক মধ্যবর্তীস্থানে বাঁধানো ঘাটসহ একটি সুন্দর পুকুর খনন করা হয়- যা এখনও বিদ্যমান রয়েছে।
থাকা-খাওয়া এবং পড়া-লেখার পাশাপাশি হলের ছাত্রদের খেলাধুলার জন্যও বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন পর্যাপ্ত ব্যবস্থার সুপারিশ করে। এসবের মধ্যে ছিল- হল অভ্যন্তরে ক্রিকেট পিচ, ফুটবল ও হকির জন্য দু’টি মাঠ এবং পাঁচটি টেনিস কোর্ট স্থাপন করার প্রস্তাব। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে জগন্নাথ হলের অভ্যন্তরে একটি বড় মাঠ (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত), দু’টি টেনিস কোর্ট, একটি বাস্কেট বল কোর্ট এবং বড় মাঠের পশ্চিম প্রান্তে ব্যায়াম করার জন্য সামান্য কিছু স্থাপনার ব্যবস্থা করা হয়। মৌসুমভেদে বড় মাঠটি ফুটবল ও ক্রিকেট- উভয় খেলার জন্য ব্যবহত হতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে জগন্নাথ হলের যথাসম্ভব একটি রূপ উপরে চিত্রায়ণ করা হয়েছে। তবে সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে এই হলের ভৌত অবকাঠামোগত রূপ, ব্যবহার এবং এমনকি অস্তিত্ব একাধিকবার পরিবর্তিত হয়েছে। পরিবর্তনের এই ধারায় মিশে আছে বর্তমান বাংলাদেশ, তৎকালীন পাকিস্তান এবং অভিবক্ত ভারত বর্ষের ইতিহাস, আন্দোলন, সংগ্রাম, তথা ঘটনাবহুল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। তবে ১৯২১ সাল থেকে চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত জগন্নাথ হলের আদি রূপ ও বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তিত ছিল।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে পুঁথিগত বিদ্যার্জনের পাশাপাশি হলের ছাত্রদেরকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সর্বোত ব্যবস্থা রাখা হয়। এরই অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে নিয়মিত প্রতিনিধি নির্বাচন করে হলের ছাত্র সংসদের মাধ্যমে জ্ঞানচর্চা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শরীরচর্চা- তথা খেলাধুলা প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ১৯২২ সাল থেকে বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত জগন্নাথ ছাত্র সংসদ কর্তৃক নিয়মিতভাবে ‘বাসন্তিকা’ নামের বার্ষিক সাময়িকী প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া নিয়মিত পুনর্মিলনী, খেলাধুলা এবং নাটকের আয়োজনসহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্যদিকে সে সময় হল প্রশাসনের উদ্যোগ এবং তত্ত্বাবধানে ছাত্ররা সমাজসেবা ও উন্নয়মূলক কর্মকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রণ করেন। জগন্নাথ হলের ছাত্রদের পড়ালেখার পাশাপাশি মেধামনন, মানসিক, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সামাজিক, ক্রিড়া প্রভৃতি কর্মকাণ্ডের এই ধারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পূর্ব পর্যন্ত অবিরত চলতে থাকে ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দশকে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে- জগন্নাথ হলের দ্বিতীয় প্রভোস্ট জগদ্বিখ্যাত ইতিহাসবিদ এবং ১৯৩৭-১৯৪২ মেয়াদকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরে উপাচার্য ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারের আমন্ত্রণে ১৯২৬ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঢাকা আগমন। তিনি ঐ বছর ৭ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অবস্থান করেন। বিশ্বকবিকে বিশেষ যত্নসহকারে জগন্নাথ হলের প্রভোস্টের বাসভবনে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। তাছাড়া বিশেষ আয়োজনে দুইদিন বুড়িগঙ্গায় বোটে তাঁর বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়। ১১ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ হলে বিপুল সমারোহে কবিগুরুকে সংবর্ধনা দেওয়ার আয়োজন করা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়- হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে কবিগুরু তাতে যোগদান করতে পারেননি। তবে জগন্নাথ হলের বাসন্তিকা সমায়িকীতে প্রকাশের জন্য ছাত্রদের অনুরোধে ‘বাসন্তিকা’ শিরোনামের বিখ্যাত গীতিকবিতা লিখে দিয়ে তিনি সংবর্ধনা সভায় অনুপস্থিতির মনোবেদনা অনেকটা পুষিয়ে দেন। স্বহস্তে লিখিত কবিগুরুর এই গীতিকবিতাটি জগন্নাথ হলসহ এ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকাশানায় অবিকল মুদ্রিত হয়ে আসছে। তাই এটি জগন্নাথ হলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ঋদ্ধ করেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন এবং পাকিস্তান আমলের প্রথম এক দশক জগন্নাথ হলের নিজস্ব সত্তা বিপন্ন হয়। তখন সরকারি আদেশবলে জগন্নাথ হল অধিগ্রহণ করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশ সরকার যুদ্ধের আনুষঙ্গিক কাজে ব্যবহারে এবং ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান সরকার হলটির উত্তর বাড়িকে অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের অফিস, দক্ষিণ বাড়িকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিস এবং অ্যাসেমব্লি হাউজকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান লেজিসলেটিভ অ্যাসেমব্লি হাউজ হিসেবে ব্যবহার করে। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত অ্যাসেমব্লি হাউজ পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের অধিবেশন বসার স্থান হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন এবং ’৪৭-এ দেশ ভাগের সময় কয়েক বছর জগন্নাথ হলের সাথে যুক্ত ছাত্ররা ঢাকা হলে বসবাস করেন। এ সময় হল দু’টি ‘ঢাকা-জগন্নাথ হল’- এই যুক্ত নামে একজন প্রভোস্টের প্রশাসনাধীনে পরিচালিত হয়। ১৯৪৬ সাল থেকে সীমিত সংখ্যক ছাত্র জগন্নাথ হলে ফিরে আসতে শুরু করেন। ’৪৭-এ দেশ বিভাগের কারণে জগন্নাথ হলের ছাত্রসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়ে যায়। তা সত্ত্বেও এ সময় হলের উত্তর বাড়ির তৃতীয় তলা নির্মাণ করা হয় এবং সেখান থেকে অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের অফিস সেগুন বাগিচার বর্তমান এজিবি অফিস এলাকায় সরিয়ে নেয়া হয় বটে, কিন্তু দক্ষিণ বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিস বহাল থাকে।
বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের সাথে জগন্নাথ হলের নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ হল অ্যাসেমব্লি হাউজে গণপরিষদের অধিবেশন শুরুর প্রস্তুতি চলছিল। পুলিশের গুলির খবর জানতে পেরে মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশসহ বিরোধী দলীয় বেশ কয়েকজন সদস্য অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করে বিক্ষুদ্ধ ছাত্রদের সাথে যোগদান করেন। ফলে বেগবান হয় ভাষা আন্দোলন।
১৯৫৭ সালের ১ জুলাই আংশিক স্থাপনা নিয়ে জগন্নাথ হল কেবলামত্র উত্তর বাড়িতে স্বতন্ত্রভাবে স্বনামে পুনরায় যাত্রা শুরু করে। বিখ্যাত দার্শনিক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব প্রভোস্ট এবং সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ও জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা হলের হাউজ টিউটর হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। উল্লেখ্য, এই তিনজন মহৎ শিক্ষকই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হন। প্রভোস্ট এবং হাউজ টিউটরদের পরামর্শ ও অনুপ্রেরণায় হল ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিবৃন্দের জোরালো দাবি ও দেনদরবারের ফলে ১৯৬১ সালের ২৫ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অ্যাসেমব্লি হাউজ জগন্নাথ হল কর্তৃপক্ষের নিকট ফেরত প্রদান করে।
দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত ভারতের জব্বলপুরে ১৯৬৪ সালে সাম্প্রাদয়িক দাঙ্গার জের ধরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়। ১৪ থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা এবং এর আশেপাশের এলাকা ও জেলাগুলোতে সংঘটিত একতরফা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রায় ১০ হাজার হিন্দুর প্রাণহানি ঘটে। হাজার হাজার হিন্দু অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হন। তিনজন আইন পরিষদের সদস্যসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে জগন্নাথ হলেও ৮ শতাধিক হিন্দু আশ্রয় গ্রহণ করেন। অমুসলমান হবার কারণে এ হলের ছাত্ররাও তখন নিরাপদ ছিলেন না। তা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলের প্রগতিশীল ছাত্রদের সহায়তায় তারা দিনরাত অক্লান্তভাবে জগন্নাথ হলে আশ্রিতদেরকে সেবা-শুশ্রুষার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান রেজিস্ট্রার বিল্ডিং-এর নির্মাণ কাজ শেষ হলে ১৯৬৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জগন্নাথ হলের দক্ষিণ বাড়ি হল কর্তৃপক্ষের নিকট ফেরত প্রদান করেন। দক্ষিণ বাড়ির দক্ষিণ উইং বরাবর রাস্তার পূর্বপাশে একটি টিনশেড ঘরে ছাত্রদের জন্য একটি ক্যান্টিন স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এটি সুধীরের ক্যান্টিন নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিল।
জগন্নাথ হলের বিভিন্ন ভবন বহু বছর সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকার কারণে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে অমুসলমান ছাত্রদের আবাসিক সংকুলানের অভাব দেখা দেয়। এ অভাব পূরণে হল ক্যাম্পাসে পুকুরের পশ্চিম দিকটায় পশ্চিম বাড়ি এবং বর্তমানে যেখানে রবীন্দ্র ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, সেখানে পূর্ব বাড়ি নামে দু’টি অস্থায়ী টিনশেড ভবন নির্মাণ করা হয়। সমসাময়িককালে পুকুরের উত্তর-পশ্চিম পাশে ক্যান্টিন এবং ছাত্রদের অভ্যন্তরীণ ক্রীড়াকক্ষ ও সংবাদপত্র পাঠাগারবিশিষ্ট দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়। স্বাধীনতার অব্যবহতির পর টিনশেড ভবন দু’টি ভেঙ্গে ছাত্রদের থাকার জন্য পূর্ব বাড়ির স্থানে রাতারাতি দ্বিতল দালান নির্মাণ করা হয়। ছাত্রদের ক্রমবর্ধমান আবাসিক সমস্যার চাপে পরবর্তীতে এটি চারতলা করা হয়। একসময় পুকুরের পশ্চিম পাড়ের টিনশেড ভবনটিও ভেঙ্গে ফেলা হয়।
প্রতিষ্ঠাকালে জগন্নাথ হল ক্যাম্পাসে হলের ছাত্রদের খেলাধুলার জন্য প্রশস্ত মাঠসহ অন্যান্য যেসব ব্যবস্থা করা হয় কালের পরিক্রমায় সেসবের অনেক কিছুই বিলুপ্ত হয়ে বা বদলে গেছে। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন কিছু স্থাপনা। এ সম্পর্কিত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে জগন্নাথ হলের সংশ্লিষ্টতা অন্যন্যসাধারণ। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই ছাত্রাবাসের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী প্রমুখ অকুতোভয়ে অংশগ্রহণ করেছেন, অকাতরে আত্মাহুদি দিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে জগন্নাথ হল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীয় অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। হানাদাররা হলের রুমে-রুমে তল্লাশি চালিয়ে নির্বিচারে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী হত্যা করে পৈশিাচিক উল্লাসে মেতে উঠে। ঐ রাতে এবং পরের দিন ২৬ মার্চ ভোরে ৬০ জনের অধিক মানুষ হত্যা করে পাকিস্তনীরা জগন্নাথ হলের উত্তর বাড়ীর সামনে মাটিতে পুঁতে রাখে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নূরুল উলা গোপনে ঐ পৈশাচিক গণহত্যার ভিডিও চিত্র ধারণ করেন। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানীদের দ্বারা সংঘঠিত গণহত্যার সরাসরি ধারণকৃত এটিই একমাত্র ভিডিও চিত্র, যা কালের নির্মম সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
১৯৫২ সালের ভাষা শহীদদের স্মরণে ১৯৬৮ সালে মাঠের উত্তর-পশ্চিম দিকে উত্তর বাড়ির সামনে শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়- যা ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তারনীরা ভেঙ্গে ফেলে। স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী জগন্নাথ হলের তৎকালীন উত্তর বাড়ির সামনে হলের শিক্ষক, ছাত্র, কর্মকর্তা, কর্মচারী প্রমুখ ৬০ জনকে নির্বিচারে হত্যা করে। হায়েনারা একটি গর্ত খনন করে সেখানে শহীদানদের শবদেহ পুঁতে রাখে। দেশ স্বাধীন হবার পর হলের ছাত্রদের রক্ত বিক্রি করা অর্থে হলের বর্তমান শহীদ মিনারসহ ’৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হলের শিক্ষক, ছাত্র এবং অন্যান্যদের স্মরণে নামফলক নির্মাণ করা হয়। ১৯৮১ সালে ইট, বালু, সিমেন্ট ও লোহার গ্রীল দিয়ে একটি গণসমাধি নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে ৬৬ জন শহীদের নামফলক এবং ২০১৯ সালে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও গণসামাধি পুনর্নিমাণ করা হয়।
১৯৮০ সালে ক্যান্টিন ও ছাত্রদের অভ্যন্তরীণ ক্রীড়াকক্ষ ও সংবাদপত্র পাঠাগার ভবনে জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদ কার্যালয় স্থাপন এবং পূর্ব বাড়ির নাম পরিবর্তন করে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্যতম শহীদ শিক্ষক ড. সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্যের নামে নামকরণ করা হয়। অন্য তিনটি ভবনের নাম পরিবর্তন করে অন্য তিনজন শহীদ শিক্ষকের নামে নামকরণের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জগন্নাথ হল প্রস্তুত ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বরণ করে নেওয়ার জন্য। কারণ, ঐ দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে চ্যান্সেলর হিসেবে যোগ দেওয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর। সমাবর্তনে যোগদানশেষে ক্যাম্পাসের যে কয়টি স্থান তাঁর পরিদর্শনের জন্য নির্ধারিত ছিল, সেসবের মধ্যে জগন্নাথ হল গণসমাধি ছিল অন্যমত। কিন্তু দেশি-বিদেশি সামরিক ও বেসামরিক চক্রান্তকারী ও হায়েনারা সেদিন সপরিবার তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। জাতির পিতাকে বরণ করে নেওয়ার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেই সাথে জগন্নাথ হল। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর জগন্নাথ হলের ছাত্রদের উপর নেমে আসে সামরিক স্বৈরাচারের অত্যাচার-নির্যাতন। তা সত্ত্বেও এই ছাত্রাবাসই তখন হয়ে উঠে মুজিব-বলয়ের প্রধান আশ্রয়কেন্দ্র। পঁচাত্তর পরবর্তী প্রতিটি সামরিক ও বেসামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন জগন্নাথ হলের ছাত্ররা।
পূর্বে হলের ছাত্র সংসদের দোতালায় ছাত্রদের সংবাদপত্র পাঠ, টেবিল টেনিস, ক্যারম এবং দাবা খেলার ব্যবস্থা ছিল। সেখানে একটি বিশালকারের রেডিও ছিল। ছাত্ররা সকাল-বিকাল খবর এবং টেস্ট ক্রিকেটের কমেন্ট্রি শোনার জন্য সেখানে ভীর জমাতো। নীচে একপাশে টিভি রুম, অন্যপাশে ছিল জিতেনের ক্যান্টিন।
১৯৭৯-৮০ সালে দোতালায় ছাত্র সংসদ অফিস স্থাপন করা হলে টেবিল টেনিস খেলা নীচে নিয়ে আসা হয়। আর এ সময় হলে প্রথম একটি রঙ্গিন টিভি এনে তা অ্যাসেমব্লি হাউজের অডিটরিয়ামে স্থাপন করা হয়। ৯০ দশকের পর দক্ষিণ বাড়ির সামনে পূর্বে যেখানে সুধীরের ক্যান্টিন ছিল সেখানে সংবাদপত্র পাঠগার এবং অভ্যন্তরীণ খেলার ব্যবস্থা করা হয়। তবে বর্তমানে জগন্নাথ হলে আর কোন রেডিও শোনার ব্যবস্থা নেই।
৭০ দশকের মাঝামাঝি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাঠের দক্ষিণ দিকে গ্যালারি এবং মাঠের ঠিক মাঝখানে স্থায়ীভাবে ক্রিকেট পিচ নির্মাণ করে। সেই থেকে জগন্নাথ হলের মাঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাছাড়া নব্বই দশকের শুরুর দিকে মাঠের পশ্চিম দিকে বাস্কেট বল এবং লন টেনিস কোর্টের অংশবিশেষ নিয়ে উপাসনালয় নির্মাণ করা হয়। উপাসনালয়ের বাইরে একদিকে বিবেকানন্দ এবং অন্যদিকে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি নির্মাণ করা হয়।
১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় টেলিভিশন দেখার জন্য হলের অ্যাসেমব্লি হাউজের অডিটরিয়ামে ছাত্রসহ অন্যরা ভীর করেন। লোহার জং ধরা জরাজীর্ণ কাঠামোয়ালা অডিটরিয়ামের ছাদ বৃষ্টির জলে ভীজে ভারি হয়ে হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ে। এতে হলের ছাত্র, কর্মচারী এবং অতিথিসহ মোট ৩৯ জনের প্রাণহানি ঘটে। পরে গোটা অ্যাসেমব্লি হাউজ ভেঙ্গে সেখানে ১৫ অক্টোবর নিহতদের স্মরণে বর্তমান ‘অক্টোবর স্মৃতি ভবন’ নির্মাণ করা হয়। অক্টোবর স্মৃতি ভবন নির্মাণকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছাত্রদের আবাসিক সংকুলানের জন্য হলের ছাত্র সংসদ কার্যালয়ের ঠিক দক্ষিণ পাশে টিনেশেড নির্মাণ করা হয়। এ সময়ে পূর্ব বাড়ির পেছনে একটি টিনশেড ক্যান্টিন ভবন নির্মাণ করা হয়। পূর্বে উল্লেখিত সুধীরের ক্যান্টিন সেখানে স্থানান্তর করা হয়। ছাত্রদের আবাসিক সমস্যা নিরসনে অ্যাসেমব্লি হাউজের স্থলে ১৯৮৬ সালে দ্রুততার সাথে পাঁচতলা বিশিষ্ট ‘অক্টোবর স্মৃতি ভবন’ নির্মাণ করা হয়। ভবনের দু’টি ব্লকের মধ্যবর্তীস্থানে ‘অক্টোবর স্মৃতি স্তম্ভ’ নির্মাণ এবং এতে প্রবেশের বাঁ পাশে পুরানো অ্যাসেমব্লি হাউজের সিঁড়ি সংরক্ষিত করা হয়, যেখানে ২০১৪ সালে জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের আর্থিক সহায়তায় ‘স্মৃতি অক্টোবর’ নামে একটি স্মারকস্তম্ভ এবং স্থায়ী ছাউনি নির্মাণ করা হয়। তাছাড়া, এই ভবনে প্রাধ্যক্ষ কার্যালয়সহ তাঁর সহযোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দপ্তরসহ অক্টোবর স্মৃতি মিলনায়তন এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। অন্যদিকে হলের প্রত্যেক ভবনেই পূর্বাপর হাউজ টিউটরদের জন্য দপ্তর বিদ্যমান রয়েছে এবং হাউজ টিউটরদের জন্য শহীদ অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য আবাসিক শিক্ষক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
২০০৭-২০১৩ সময়কালে হল পুকুরের পশ্চিম পাশে দশতলা ফাউন্ডেশনের আটতলা পর্যন্ত ছাত্রদের জন্য একটি আবাসিক ভবনের নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়। ২০১৩-২০১৪ সালে ‘সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ভবন’ (পূর্ববাড়ী)-এর ছাত্রদেরকে নতুন এই ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়। ২০১৪ সালে পূর্ববাড়ী ভেঙ্গে ফেলে নবনির্মিত ভবনের নামকরণ করা হয় ‘সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ভবন’। এই ভবনে হাউজ টিউটর অফিস ও তাদের আবাসস্থল, ডাইনিং হল ও ক্যান্টিন, দর্শনার্থী কক্ষ ইত্যাদি’র ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া এখানে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ই-লাইব্রেরি, শহীদ অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য স্মৃতি গ্রন্থাগার, শহীদ মৃণাল কান্তি বোস স্মৃতি পাঠাগার এবং অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত কনফারেন্স রুম স্থাপন করা হয়েছে। সম্প্রতি এই ভবনের দশতলা নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়েছে এবং এটি হল কর্তৃপক্ষ বুঝে পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। অন্যদিকে, ২০১৯ সালে পুরানো পূর্ববাড়ী’র স্থানে দশতলাবিশিষ্ট ‘রবীন্দ্র ভবন’ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর জগন্নাথ হলের ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে আবাসন সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। সেখানে ছাত্ররা গাদাগাদি- অর্থাৎ ডাব্লিং, ট্রিপ্লিং এবং ফ্লোরিং করে কক্ষে ধারণ ক্ষমতারে চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি সংখ্যক ছাত্রদেরকে বাস করা এই হলের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘রবীন্দ্র ভবন’ নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের বহুকালের এই দুর্দশার পরিসমাপ্তি ঘটবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা যাচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, ছাত্রসংখ্যার বিচারে জগন্নাথ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তম আবাসিক ছাত্রাবাস। বর্তমানে জগন্নাথ হলের সীট সংখ্যা ১৬৭০টি এবং আবাসিক ও অনাবাসিক মিলিয়ে হলের সাথে সংযুক্ত রয়েছেন ২৪৪৫ জন ছাত্র।
জগদ্বিখ্যাত শিক্ষাবিদ, ইতিহাসবিদ, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতি পর্যায়ের স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন সময় জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে শুরুর দিকে জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদ কর্তৃক নিয়মিতভাবে ‘বাসন্তিকা’ নামে হলের ঋদ্ধ একটি বার্ষিক ম্যাগাজিন প্রকাশিত হত। কিন্তু পরবর্তীতে ছাত্র সংসদের নিয়মিত নির্বাচন না হওয়ার কারণে প্রকাশনাটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে ১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জগন্নাথ হল প্রতিষ্ঠার হীরকজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে ‘বাসন্তিকা’র সর্বশেষ সংস্করণটি প্রকাশিত হয়।
অন্যদিকে জগন্নাথ হলে ছাত্রদের জন্য খাবারের মান কোন্ যুগে উন্নত ছিল তার হদিস মেলা ভার। খাবার নিয়ে এ হলের সকল বয়সের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রদের মধ্যে অনেক রসালো আলাপ প্রচলিত রয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর এ হলে চারটি ভবন থাকলেও ছাত্রদের সকাল-বিকাল নাস্তা করার জন্য হল ছাত্র সংসদ ভবনের নীচে ও দক্ষিণ বাড়ির সামনে দু’টি ক্যান্টিন এবং উত্তর ও দক্ষিণ বাড়িসংলগ্ন দু’টি ডাইনিং হল চালু ছিল। এসব ক্যান্টিন ও ডাইনিং ভেন্ডরদের কর্তৃক বিনাভাড়ায় পরিচালিত হত, তবে ছাত্রদেরকে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে খাবার পরিবেশনের শর্ত তাদের উপর আরোপিত ছিল। বর্তমানে উত্তর বাড়ি, অক্টোবর স্মৃতি ভবন ও সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ভবনে ভেন্ডরদের কর্তৃক একই শর্তে ক্যান্টিন এবং দক্ষিণ বাড়ির ডাইনিং হলে একটি ও হল ছাত্র সংসদ ভবনের নিচে ছাত্রদের দ্বারা দু’টি মেস্ পরিচালিত হচ্ছে। মেসগুলোর মধ্যে ছাত্র সংসদ ভবনের মধ্যে একটিতে আমিষ ও অন্যটিতে নিরামিষ এবং দক্ষিণ বাড়ির মেসটিতে আমিষ খাবার পরিবেশন করা হয়। উল্লেখ্য, পূর্বে জগন্নাথ হলে নিরামিষ ও আমিষ খাবারের আলাদা ব্যবস্থা না থাকলেও বর্তমানে তা করা হচ্ছে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপদান করার মানসে সেখানে শুধু পুঁথিগত বিদ্যার্জন নয়, সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার মানসিক, শারীরিক, সাংস্কৃতিক এবং চারিত্রিক প্রশিক্ষণদানের জন্য প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ ও জ্ঞানচর্চার ব্যবস্থা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলের সাথে জগন্নাথ হলেও ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠাপূর্বক এর মাধ্যমে এসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে থাকে। ১৯২৪-২৫ থেকে ১৯৪৭-৪৮ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত বিরতিহীন প্রতিবছর নিয়মিতভাবে হল সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা-জগন্নাথ হলের যুগ্মসত্তায় ১৯৪৮-৪৯ থেকে ১৯৫৬-৫৭ শিক্ষাবর্ষ এবং জগন্নাথ হলের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব পুনর্বহাল হলে ১৯৫৭-৫৮ থেকে ১৯৬৯-৭০ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্তও বিরতিহীন হল সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে সহজেই অনুমেয় মহান মুক্তিযুদ্ধের ডামাডোলে ১৯৭০-৭১ শিক্ষাবর্ষে হল সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আর স্বাধীন বাংলাদেশে অনিয়মিতভাবে ১৯৭২-৭৩, ১৯৭৯-৮০, ১৯৮০-৮১, ১৯৮৩-৮৪, ১৯৮৮-৮৯ এবং ১৯৮৯-৯৯০ শিক্ষাবর্ষে ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তারপর টানা ২৯ বছর ডাকসু এবং হল সংসদের কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি বিধায় ক্ল্যাসরুমকেন্দ্রিক ও পুঁথিগত শিক্ষা বর্হিভূত হল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কর্মকাণ্ড আয়োজনে বেশ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ১৯২৪-১৯২৫ থেকে ১৯৮৯-১৯৯০ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত নিয়মিত ও অনিয়মিত এবং স্বতন্ত্র ও যুগ্ম সত্তায় জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের তালিকা ফলকের ছবি এখানে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনের সময় জগন্নাথ হল ছাত্র সংসদে উৎপল বিশ্বাস সহ-সভাপতি এবং কাজল দাস সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন।
দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদের অনুপস্থিতিতে হল কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন ছাত্র-রাজনৈতক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি কর্তৃক নিয়মিতভাবে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, অক্টোবর স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট এবং অনিয়মিতভাবে বার্ষিক ফিস্ট আয়োজিত হয়েছে। পূর্বে ডাকসুর পরিচালনায় কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, যথা- খেলাধুলা, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চামূলক প্রতিযোগিতায় জগন্নাথ হলের ছাত্রদের পারঙ্গমতা সকলের কাছে ঈর্ষণীয় ছিল। অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ছিল হলের ছাত্রদের জন্য আকর্ষণীয় কসরত ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড। দীর্ঘদিন তাও আয়োজিত হয়নি। ডাকসু’র অনুপস্থিতিতে সেসব অনুষ্ঠান তেমন করে আয়োজন করা সম্ভব হয়নি বিধায় এখন অনেকটা ভাটা পড়েছে। দীর্ঘদিন পর ২০১৯ সালে নির্বাচিত ছাত্র সংদস কিছু কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলেও করোনাভাইরাস সংগ্রমণের কারণে সবকিছু এখন স্থবির হয়ে রয়েছে।
অন্যদিকে, ৯০ দশকের পূর্ব-অবধি জগন্নাথ হলে টেনিস খেলার কোর্টের পূর্বদিকে মণ্ডপ নির্মাণ করে
অন্যদিকে, ৯০ দশকের পূর্ব-অবধি জগন্নাথ হলে
Editor & Publisher : Sukriti Mondal.
E-mail: eibelanews2022@gmail.com