কোতয়ালী থানায় ওসি সাহেব আমার উপরে বেজায় খুশি তাই আমার নিজের কাছে ভালো লাগছে, কারণ ভীষণ আতঙ্ক নিয়ে তার বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলাম। বলতে গেলে এটা সেই আতঙ্ক কেটে যাওয়ার আনন্দ। মানুষের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির জায়গাটা যখন এক হয়ে মিলে যায় তখন ভালো লাগতে শুরু করে। আমি জানিনা কোতয়ালী থানায় ওসি সাহেব আমার কাছে কী প্রত্যাশা করেছিল আর প্রাপ্তিটাই বা তার কি ছিল। যাই হোক আমি ওসি সাহেবের কাছ থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসতে পেরেছি এটাই আমার কাছে অনেক বড় আনন্দের। সব সময় কারো সাথে সম্পর্ক তৈরি হতে সময় লাগে, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো, অল্প সময়ের মধ্যেই কলেজের বন্ধুবান্ধব, টিউশনের জায়গাগুলোতে, লজিং মাস্টার বাড়ি, আশপাশের সমাজব্যবস্থা সহ ফরিদপুরের অনেকের সাথে পরিচয় এবং সুসম্পর্ক তৈরি হতে লাগলো আমার। সেই সাথে ফরিদপুরের ছাত্র নেতাদের সাথেও পরিচয় হয়ে গেল আমার পর্যায় ক্রমে। রাশিফল চক্র গণনার অভিজ্ঞতার কারণে ডাক পড়লো আমার সমাজের বিভিন্ন মহল থেকে, বিভিন্ন প্রফেশনাল মানুদের সাথে সম্পর্ক বাড়তে থাকলো দিনের পর দিন। ইতিমধ্যে ডাক এসেছে আমার আলীপুরের সেলিম ভাই, রাজু ভাই, প্রানবল্লব বাবু, রামু দা, পলাশ ভাই, ফান্টা ভাই, অনিমেষ দা, আরিফ ভাই, শামিম সহ আরো অনেকের কাছ থেকে। প্রতিনিয়ত ডাক পড়ছে আমার হরিসভা, কমলাপুর, চরকমলাপু, খাবাসপুর, ঝিলটুলি, রতখোলা, লক্ষিপুর, গোয়ালচামট সহ ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে। কলেজে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আড্ডার ছলে বন্ধুদের আগ্রহে বন্ধুদের আনন্দ দিতে গিয়ে রাশিচক্র গণনার যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি আমি সেটা আমাকে রীতিমত ভাবিয়ে তোলে। বন্ধুমহলে নিজেকে আলাদা ভাবে তুলে ধরতে, আনন্দের সহিত আমার অর্জিত এই অভিজ্ঞতার শেষ কোথায় আমি জানিনা। আমি বুঝতে দেইনা, আমার মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে দারিদ্রতার ছোয়া। অন্যকে একটু বিনোদন দেওয়ার জন্য আমি হয়তো ভুলেই গেছি দুপুরে আমার খাওয়া হয়নি। আমি ইতিমধ্যে বুঝতে শিখে গেছি সত্যিকার জীবনের মানে। জীবনকে জীবনের গতিতে চলতে দেওয়া যাবে না বরং আমাকে জীবনের সামনে রুখে দাঁড়াতে হবে, সময় অপচয় এর লাগামটা চেপে ধরতে হবে আমায়। আজকের সকালটা, আজকের দিনটা আমায় জন্য কার্যকরী না হলে এই মাসটা এই বছরটা আমায় জন্য কার্যকরী হবে না। তাই প্রতিটা দিনের, প্রতিটা ঘন্টার জবাবদিহিতা আমার নিশ্চিত করতে হবে। কোন সমস্যাই জীবনের থেকে বড় হতে পারে না, কোন ব্যর্থতাই জীবনের সব সম্ভাবনাকে মুছে দিতে পারে না। কারো অভিমত, কারো ভালো লাগা, কেউ আমার পাশে আছে তার উপর নির্ভর করে আমি ভালো থাকব এটা ভাবার কোন মানে হয় না আমার। কারো প্রেম-ভালবাসা, আশা-ভরসা কোন কিছুই স্থায়ী নয়। আমার জীবন, আমার চিন্তা-ভাবনা আমার আবেগের থেকেও অনেক বড়। আমার হতাশা কাটাতে জীবনকে ধাক্কা দিতে হবে আমায়, আমার ভেতরের ঘুমন্ত মানুষটাকে জাগাতে হবে, স্পৃহা বাড়াতে হবে আমায়। কারণ জীবনের চিন্তাভাবনাগুলো ধাপে ধাপে আয়ত্ত করতে পারলেই জীবন নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে এটা আমি এতদিনে বুঝতে শিখে গেছি। কারণ আজকে আমি যে অবস্থানে আছি এটাই আমার বাস্তবতা, আমার এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবে না এটাকে মেনে নিয়েই আমাকে সামনের দিকে আগাতে হবে। আগে আমি কি ছিলাম সেই ইতিহাস নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না বরং সামনের দিনগুলোতে নিজেকে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, আমায় সেই ভাবনায় আমি মশগুল। আমার মনকে আমি বোঝাতে থাকলাম সাথের বন্ধুদের অবস্থান চিন্তা করে হতাশ হওয়া যাবে না, চেষ্টার তেজ বাড়াতে হবে আমার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। এ সমাজ আর বন্ধুদের উপহাস উপেক্ষার জবাব দেয়ার জন্য মিরাক্কেল কোন কিছু না খুঁজে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে আমায়। তাই মিছামিছি স্বপ্ন দেখে আমার কোন লাভ নাই তবে হ্যাঁ, চেষ্টা করলে লাভ আছে। রুটিন বানানো কোন অর্জন না, কাজ করাটা অর্জন। শুধু আশা নিয়ে বসে থাকলে কোন পরিবর্তন আসবে না আমার, যদি লেগে থেকে সাধনা করি পরিবর্তন আসতেও পারে। তাই স্বপ্ন দেখা বাদ দিয়ে বাস্তবে বেশি বেশি চেষ্টা শুরু করলাম। আমি বাস্তবতার বিপরীতে চেষ্টা করতে করতে আমার মনোবল বৃদ্ধি হতে শুরু করল, কিন্ত পরিস্হিতি আমাকে পরীক্ষায় ফেলছে প্রতিনিয়ত।
আমার জীবনের আনন্দ আর বেদনার মাঝে কবে বৃষ্টির দিন শেষ হয়ে শীতের আভা চলে এসেছে আমি বুঝতেই পারি নাই। সময়টা আমার যাচ্ছে নিজের কষ্টকে চাপা দিয়ে অন্যদেরকে একটু আনন্দ দেওয়ার চেষ্টায়। তাই যেখানে যে অবস্থায় থাকতাম কাজের থেকে চিন্তায় আমাকে আকড়ে রাখতো বেশী। আমি টিউশনি শেষ করে সন্ধ্যায় থানা রোডের পুস্তক ঘড় থেকে হেটে আসার সময় কুটু ভাইয়ের মর্ডান ফার্নিচারের দোকানে বসলাম। ভীষন শীত পড়েছে, মনে হলো এটাই এবছরের সব চেয়ে বেশী শীত। শীতে আমাকে এতোটাই কষ্ট দিচ্ছে যা আগে কখনই আমি পাই নাই। কুটু ভাইের দোকানের পাশে ছোট্ট একটি বাচ্চা ছেলে মাটির মধ্যে বসে আছে ও আমার চেয়েও কম শীতবস্ত্র পড়া। ওকে দেখে সান্তনা নিয়ে শরীরে গরম অনুভব করতে শুরু করলাম। ইতিমধ্যে পলাশ ভাই কুটি ভাইয়ের দোকানে ঢুকলো আর আমাকে দেখে তো আত্মহারা। পলাশ ভাইকে আমি দুই-তিন দিন আগে হাত দেখে বলেছিলাম এক সপ্তাহের মধ্যে অর্থ যোগের সম্ভাবনা আছে আর আজই তিনি বড় অঙ্কের একটি বিল পেয়েছে, যা ছিলো পলাশ ভাই এর অপ্রত্যাশিত। পলাশ ভাইতো আমাকে বুকে জরিয়ে ধরলো আর সে দেখলো আমি শীতে থর থর করে কাপছি। পলাশ ভাই রাজনীতি করে, খুব খোলা মনের মানুষ। শীতে আমার দুরঅবস্থা দেখে আমাকে জোর করে নিয়ে গেল নিউ মার্কেটে জিনাতের দোকানে। জিনাতের দোকানটি নিউমার্কেটে সিড়ি কোটার নিচে, অনেক দামি দামি জিন্স প্যান্ট এবং কেডস বিক্রি করে। আমাকে পলাশ ভাই ৩,২০০/- টাকা দিয়ে একটি জিন্সের প্যান্ট, একটি শার্ট এবং একজোড়া কেডস কিনে দিলো। পৃথিবীতে খুব কম লোকই আছে স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে কারো জন্য কিছু করে। কেউ বিপদে পাশে দাঁড়ালে, ক্ষনিকের ভালোলাগাতে মুহূর্তের মধ্যে ভুলে যায় কে আপন কে পর। পলাশ ভাই এমন ভাবে সব কিছু কিনে দিল আমাকে, মনে হলো আপন বড় ভাই ছোট ভাইয়ের জন্য কেনাকাটা করে দিচ্ছে। আমি অবাক দৃষ্টিতে পলাশ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। চলবে...
নি এম/