eibela24.com
শুক্রবার, ১৯, এপ্রিল, ২০২৪
 

 
ব্যারিস্টার পি আর ঠাকুর জন্ম ও র্কম ইতিহাস
আপডেট: ১০:৫১ pm ২৩-১১-২০২০
 
 


এ্যাড উৎপল বিশ্বাস

ব্যারিস্টার প্রমথরঞ্জণ ঠাকুর (১৯০২ - ১৯৯০) পি আর ঠাকুর নামে সকলের কাছে পরিচিত। তিনি ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের সাবেক ফরিদপুর জেলা বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দি গ্রামে বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ঠাকুর পরিবারকে অবলম্বন করে দক্ষিণ বাংলার নিম্নবর্গের মানুষের জাগরণ শুরু হয়। ঠাকুর পরিবারের প্রবাদ প্রতীম দু'টি নাম শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর (১৮১২ - ১৮৭৮) এবং শ্রী শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর (১৮৪৬ - ১৯৩৭)। ব্যারিস্টার পি আর ঠাকুর ছিলেন গুরুচাঁদের পৌত্র।

পি আর ঠাকুরের পিতার নাম শশীভূষণ ঠাকুর এবং মাতার নাম অনঙ্গমোহিনী ঠাকুর। ঠাকুরের মাতা ছিলেন বরিশালের বিখ্যাত চাঁদসী পরিবারের ডা. প্রসন্নকুমার দাসের কন্যা। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে চাঁদসী চিকিৎসার প্রবর্তন করেন বিষ্ণুহরি কবিরাজ।

পি আর ঠাকুর ১৯২০ সালে ওড়াকান্দি মিড হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। কলকাতা সেন্ট পলস্ কলেজে পড়ার সময় তিনি মাতামহ ডা. প্রসন্নকুমার দাসের বাড়িতে থাকতেন। সেন্ট পলস্ কলেজ থেকে তিনি ১৯২২ সালে আই এ এবং ১৯২৪ সালে বি এ পাশ করেন। ১৯২৬ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে পি আর ঠাকুর ব্যারিস্টারি ডিগ্রি আর্জনের জন্য লণ্ডনে যান এবং পড়াশুনা শেষ করে ১৯৩০ সালে কলকাতা হাই কোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন।

১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনে নিম্নবর্গকে তফসিলি হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং অবিভক্ত বাংলায় ২৫০ আসনের মধ্যে তফসিলিদের জন্য ৩০টি আসন সংরক্ষণ করা হয়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে ফরিদপুর দক্ষিণ (সংরক্ষিত) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী রূপে ব্যারিস্টার পি আর ঠাকুর নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হবার কিছু দিন পর শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ ঘটে। গুরুচাঁদের জীবদ্দশায় তাঁর সকল পুত্র প্রয়াত হয়েছিলেন। সঙ্গত কারণে গুরুচাঁদের জেষ্ঠ্য পৌত্র হিসাবে ব্যারিস্টার পি আর ঠাকুর মতুয়াদের আধ্যাত্মিক গুরুর পদ লাভ করেন।

পার্লামেন্টারি রাজনীতির শুরুতে ব্যারিস্টার পি আর ঠাকুরের সাথে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের যোগাযোগ গড়ে ওঠে এবং ২০ জন তফসিলি সাংসদকে নিয়ে তারা গড়ে তোলেন "ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিডিউলড কাস্ট পার্লামেন্টারি পার্টি।" ১৯৪৩ সালে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল মুসলিম লীগ সরকারের মন্ত্রী হলে ঠাকুরের সাথে মণ্ডলের দূরত্ব বাড়তে থাকে এবং ঠাকুর কংগ্রেসের দিকে ঝুকে পড়েন। কংগ্রেসের সাথে সুসম্পর্ক থাকার পরেও ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে ঠাকুর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে ফরিদপুর দক্ষিণ আসন থেকে নির্বাচিত হন। সে সময় ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার পরিকল্পনা নিয়ে সংবিধান সভা গঠনের ঘোষণা দেন। ঠাকুর কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সংবিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হন।

ভারত ভাগের সাথে বাংলা ভাগের প্রশ্ন সামনে চলে আসলে ব্যারিস্টার পি আর ঠাকুর প্রথমে বাংলাকে অবিভক্ত রাখার পক্ষে অবস্থান নেন। ১৮.০৩.১৯৪৭ তারিখে দৈনিক অমৃত বাজার পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে দেখা যায় ১৪.০৩.১৯৪৭ তারিখে ঠাকুরের সভাপতিত্ব "নিখিল ভারত অনুন্নত শ্রেণি সংঘ" অবিভক্ত বাংলার পক্ষে প্রস্তাব পাশ করে। তবে ০৪.০৪.১৯৪৭ তারিখে বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেস বাংলা ভাগ করে দু'টি প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত নিলে ব্যারিস্টার পি আর ঠাকুর তাঁর পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আসেন এবং বাংলা ভাগের পক্ষে অবস্থান নেন।

১৯৪৭ সালের ১৪ অগাস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ অগাস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। ওড়াকান্দিসহ মতুয়া বসতি অঞ্চল পূর্ব বাংলা তথা পাকিস্তানে ভাগে পড়ে যায়। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ রূপে পি আর ঠাকুরের প্রতি কুলে চলে যায় এবং তিনি দেশত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান। আইন ব্যবসা এবং রাজনৈতিক কাজের সুবিধার জন্য ঠাকুর কলকাতায় আগেই একটি বাড়ি ক্রয় করেছিলেন। তিনি কলকাতার বাড়িতে অবস্থান করলে উদ্বাস্তু হয়ে আসা মতুয়া - মূলত কৃষিজীবী, মৎস্যজীবী ও নানা কায়িক পেশায় যুক্ত মানুষ - তাঁর সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না। তাই ঠাকুর কলকাতার বাড়ি বিক্রি করে প্রধান প্রধান মতুয়া ভক্তকে সাথে নিয়ে সীমান্তবর্তী বনগাঁ এবং গোবরডাঙ্গার মাঝে অবস্থিত চিকন পাড়ায় কয়েক শত একর জমি ক্রয় করেন এবং ভারতে প্রথম বেসরকারি কলোনী "ঠাকুরনগর" প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যারিস্টার এবং ভারতের সংবিধান সভার সদস্য হবার পরেও তিনি সেখানে পর্ণ কুটির নির্মাণ করে বসবাস করতে থাকেন। ধীরে ধীরে উদ্বাস্তু হয়ে আসা মতুয়াদের জন্য তিনি ওড়াকান্দির আদলে কামনা সাগর ও পূর্ণ ব্রহ্ম শ্রীশ্রী হরি চাঁদ মন্দির ও শ্রীশ্রী গুরু চাঁদ মন্দির নির্মাণ করেন এবং শ্রীশ্রী হরি চাঁদের আবির্ভাব ও মহাপ্রয়াণ তিথি মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে উৎসবের আয়োজন করতে থাকেন, যা আজ মতুয়া মহামেলায় রূপান্তরিত হয়েছে।

পি আর ঠাকুর ১৯৫২, ১৯৫৭ ও ১৯৬২ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হন এবং মূখ্য মন্ত্রী ডা. বিধান রায়ের মন্ত্রী সভায় তফসিলি ও আদিবাসী দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৬৪ সালে পূর্ব বাংলার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিম বাংলার উদ্বাস্তু অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতে পারে - শুধুমাত্র এই আশংকায় - রাজ্য সরকার উদ্বাস্তু জনপদে পিটুনি পুলিশ বসিয়ে ব্যাপক অত্যাচার শুরু করেন। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল বহিরঙ্গের থেকে ফেরার পথে হাওড়া স্টেশন থেকে গ্রেপ্তার হন। এ সবের প্রতিবাদে পি আর ঠাকুর কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে অবশ্য ঠাকুর নবদ্বীপ লোক সভা আসন থেকে বাংলা কংগ্রেসের মনোনয়ন পেয়ে ভারতে কেন্দ্রীয় আইন সভা তথা লোক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় ঠাকুরের সাথে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠে। তবে ১৯৬৮ সালে মণ্ডল প্রয়াত হলে ঠাকুর বিমর্ষ হয়ে পড়েন।

পি আর ঠাকুর অত্যন্ত নীতিবান ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। রাজনীতিতে অসততা, মিথ্যাচার, কদর্যতা তাঁর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরী করে এবং তিনি রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করেন। বাকী জীবন তিনি "মতুয়া মহাসংঘ"-কে যথার্থ ভাবে পরিচালনার জন্য ট্রাস্ট গঠন করেন।

১৯৯০ সালের ২৮ ডিসেম্বর ঠাকুরনগরে ব্যারিস্টার পি আর ঠাকুর প্রয়াত হন। চলবে....

নি এম/