ভারতের দ্য ইকোনমিক টাইমস শনিবার এক বিশ্লেষণে বলেছে, চীন বাংলাদেশকে যে বাণিজ্য ছাড় দেয়ার কথা বলেছে, সেটা আসলে বাংলাদেশের জন্য একটা ‘দ্বৈত বানিজ্য ঘাটতি’ এবং তাকে একটা ‘ঋণের ফাঁদে’ ফেলে দেয়া।
পত্রিকাটি প্রকাশিত রিপোর্টে বলেছে, চীন বাংলাদেশকে যে ধরণের শুল্কমুক্ত পণ্য সুবিধা দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে, সেটা আসলে একটা কাগুজে ঘোষণা মাত্র। কারণ বেইজিং এসব ক্ষেত্রে কঠোরভাবে রুলস অব অরিজিন মেনে চলে। সুতরাং তার এই ছাড় দেয়ার ঘোষণা কাগজেই থেকে যাবে ।
পত্রিকাটি লিখেছে, এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে একটি তথাকথিত কূটনৈতিক বিজয় দেখছে বাংলাদেশে। কিন্তু বাংলাদেশ একটা প্রতিশ্রুতিশীল অর্থনীতির দেশ। তার এই বিজয়ের ফলে বাংলাদেশ পরিণামে দুর্দশাগ্রস্ত হতে পারে। এভাবে দেশটিকে ঝুঁকিতে ঠেলে দিয়েছে। পত্রিকাটি লিখেছে, চীনা বাণিজ্য বাংলাদেশকে একটা ’ডুয়াল–ডেফিসিট’ এবং ‘ডেপ্ট ট্রাপের’ মধ্যে ফেলে দিতে পারে ।
পত্রিকাটি সতর্ক করে যে, এর ফলে বেইজিং আরোপিত শর্তগুলো ঢাকা সহজে গ্রহণ করতে পারে। তাই পত্রিকাটি পরামর্শ দিয়েছে যে, ঢাকার উচিত হবে শ্রীলংকার অবস্থা থেকে শিক্ষা নেয়া।
কারণ কলম্বো বাধ্য হয়েছিল, তার হাম্বানতোতা সমুদ্র বন্দর ৯৯ বছরের জন্য বেইজিংকে ইজারা দিতে।
পত্রিকাটির ভাষায়, যখন বিশ্ব করোনা যুদ্ধে অবতীর্ণ রয়েছে, সেই সুযোগ নিয়ে চীন বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় তার বানিজ্য এজেন্ডা বাস্তবায়নে এগিয়ে চলছে।
এই লেখায় একটা গবেষণাপত্রের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। এই গবেষণাপত্রটির শিরোনাম : ’দি বিআরআই ইন পোস্ট করোনা ভাইরাস সাউথ এশিয়া’। এই গবেষণা পত্রটি লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ন্যাশনাল ব্যুরো অফ এশিয়ান এর একজন অনাবাসিক ফেলো দীপ পাল এবং আরেকজন হচ্ছেন কার্নেগি ইন্ডিয়ার গবেষণা সহকারী রাহুল ভাটিয়া ।
যৌথভাবে লেখা এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কার্নেগী সংগঠনের ভারতীয় চ্যাপ্টার।
পত্রিকাটি বলেছে, বাংলাদেশ কানেক্টিভিটির ক্ষেত্রে বন্দর, নদী, রেল ও মহাসড়ক দিয়ে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে, যা শুধু ভারতীয় বাজার নয়, তার পক্ষে ভুটান এবং নেপালকে যুক্ত করা সম্ভব। সরকারগুলো ১৯৬৫ পূর্ব রেল সংযোগ পুনরুজ্জীবনে এক মত হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার আরও কানেক্টিভিটির যত লিংক রয়েছে, সেগুলো পুনরুজ্জীবনেও রাজি হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশে এর আগে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে রাজি হয়েছে। যাতে তারা বাণিজ্য প্রসারিত করতে পারে। বাংলাদেশ এর ফলে ভুটানে রপ্তানি করতে পারবে, উত্তর-পূর্ব ভারতে কারগো পাঠাতে পারবে।
ভারত এবং চীন বাংলাদেশকে কি সুবিধা দিয়েছে, তার একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। অবশ্য এতে চীন কি কি দিয়েছে, সেই তালিকা নেই।
এতে বলা হয়েছে, ভারত বিভিন্ন ধরনের বাংলাদেশি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা ঘোষণা করেছে চীনের শুল্কমুক্ত ঘোষণার এক দশক আগেই। আর সে কারণেই দিল্লির সঙ্গে ঢাকা তার বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের বাণিজ্য এবং ঋণ বাংলাদেশের অনুকূলে গেছে। আর বেইজিং বাংলাদেশকে বাণিজ্য ছাড় দেয়ার আগেই তার কাছ থেকে অনেক সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। কিন্তু এখন তারা যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতে ঢাকা একটা ঋণের ফাঁদে পড়ে যেতে পারে। গত এক দশক ধরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক বেড়েই চলছে। ২০১৮–২০১৯ সালে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি দাঁড়িয়েছে নয় দশমিক ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর বাংলাদেশ থেকে ভারত আমদানি করেছে একই সময়ে ১ দশমিক শূণ্য চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
পত্রিকটি ওই তথ্য দিয়ে বলেছে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ব্যাপক। আর সেটা ভীষণভাবে চীনের অনুকূলে। ২০১৮–২০১৯ সালে বাংলাদেশে চীন রপ্তানি করেছে ১৩ হাজার ৬৩৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু একই সময়ে বাংলাদেশ চীনে রপ্তানি করেছে মাত্র ৫৬৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
গত দুই দশকে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ১৬ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
অন্যদিকে ভারত বাংলাদেশকে নাটকীয় ভাবে তার সহায়তা বৃদ্ধি করেছিল। পত্রিকাটির কথায়, বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে নজর দিয়েছে ভারত। সড়ক-রেল, শিপিং এবং সমুদ্রবন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বাংলাদেশকে গত আট বছরে তিনটি লাইন অফ ক্রেডিট ঘোষণা করেছে ভারত। এর পরিমাণ ৮শ কোটি মার্কিন ডলার। পত্রিকাটি লিখেছে, সত্যি বলতে কি ভারতীয় লাইন অফ ক্রেডিট (এলওসি) পাওয়ার ক্ষেত্রে বৃহত্তম গ্রহিতা রাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশ।
পত্রিকাটির বর্ণনায়, লাইন অফ ক্রেডিট ছাড়াও বাংলাদেশকে যেসব ক্ষেত্রে সুবিধা ও ছাড় দিয়েছে ভারত, তার মধ্যে রয়েছে আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ তৈরি, বাংলাদেশে নাব্যতা বৃদ্ধি করা, নদী খনন এবং ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের নির্মাণ।
এর বাইরে স্মল ডেভলপমেন্ট প্রজেক্ট (এসডিপি) এর আওতায় বাংলাদেশকে ভারত ইতিমধ্যেই ছাত্রাবাস নির্মাণ, শিক্ষা ভবন নির্মাণ, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও এতিমখানা তৈরি করে দিয়েছে। এধরণের ৫৫ টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে ভারত এবং আরও ২৬ টি এধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
পত্রিকাটি আরো বলেছে, বাংলাদেশ-ভারতের উন্নয়ন কৌশলের মধ্যে মানব সম্পদের উন্নয়ন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে। স্কলারশীপ এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি তার অন্যতম । ২০১৯ সাল থেকে ১৮০০ বাংলাদেশি সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে ভারত। মিসৌরির ন্যাশনাল সেন্টার ফর গুড গভর্নেন্সএ তারা এই প্রশিক্ষণ লাভ করেছে। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে বাংলাদেশ পুলিশ কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন । ভারতের ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমিতে ২০১৭ সাল থেকে দেড় হাজার বাংলাদেশি বিচারক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।
পত্রিকাটি এসব তথ্য দিয়ে লিখেছে, বাংলাদেশের উচিত হবে চীনা পদ্ধতি পুরোপুরি গ্রহণ করার আগে তার বানিজ্য-বিনিয়োগ কৌশল কি হবে সে বিষয়ে পুনরায় চিন্তাভাবনা করা। বাংলাদেশের উচিত হবে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার বাণিজ্য সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানোর জন্য বাজার অনুসন্ধানে মনোযোগী হওয়া। সূএ: মানবজমিন
নি এম/
Editor & Publisher : Sukriti Mondal.
E-mail: eibelanews2022@gmail.com