সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা দিয়ে শুরু করি,
“পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের
কখনোই ভয় করিনাকো; আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হ’লো ইতিহাস।”
সতিই আমাদের ইতিহাস হলো আপোষ না করার ইতিহাস। আর এটাকে স্মরণ করিয়ে দিতে ফিরে এলো ৭১ এর ডিসেম্বর। আমাদের বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। এই মাস আসলেই আমরা আবেগে উদ্বেলিত হই, পুলকিত হই, শিহরিত হই। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। এরপর দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ হয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয়ী হই। দীর্ঘ শোষণ আর বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তির তাড়নায় ছিনিয়ে আনা বিজয়। একটি সবুজ ভূখন্ড। একটি বাংলাদেশ। শত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজকের এই অর্জন। অপেক্ষার দীর্ঘ রজনী শেষে আমরা খুঁজে পাই উদ্ভাসিত শুভ্র সকাল। বিজয়ের মাস এলেই তাই আমরা নতুন করে ভাবি।
একাত্তরে আমাদের এ স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ এক ইতিহাস। এ ইতিহাস এ দেশের ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক ও নারী-পুরুষসহ অগণিত মানুষের অকাতরে রক্ত ঝরার ইতিহাস। ১৯৪৭ সালে আমরা একবার একটা ভুয়া স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। ভারতের জন্য সেটা রাজনৈতিক স্বাধীনতা হলেও, আমাদের জন্য ছিল আরেকটি শৃঙ্খলে আবদ্ধ হবার দুর্ভাগ্য। এরপরের ইতিহাস আমাদের সবার জানা। অনেক রক্তে ভেজা, এই স্বাধীনতা, অনেক জীবন দিয়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা। তাই এই স্বাধীনতা তুচ্ছ তো নয়ই। আর তাই জাতি হিসাবে আমাদের প্রত্যাশাও অনেক। ভারতের স্বাধীনতা এসেছে আপোষের মাধ্যমে, যদিও তার পেছনে ছিল দু’শ বছরের অনেক সংগ্রাম ও জীবন দান। আর আমাদের স্বাধীনতা এসেছিল সরাসরি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে।
স্বাধীনতার মুক্তির সংগ্রামে যারা সেদিন অংশগ্রহণ করেছিল তাদের প্রত্যেকের তীব্র আকাঙ্খা ছিল আমরা স্বাধীন সার্বভৌম একটি বাংলাদেশ পাবো। গড়ে উঠবে বৈষম্যহীন সুদৃঢ় ঐক্যের সোনার বাংলা।
থাকবে না রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন; থাকবে অর্থনৈতিক সুদৃঢ় ভিত্তি। বন্ধু অবয়বে আমাদের কোনো শত্রু থাকবে না, এ দেশের প্রতি থাকবে না খবরদারি; থাকবে শুধু বন্ধুত্ব ও পরস্পর সহযোগিতার সম্পর্ক। ৪৬ বছর পরও আমাদের ভাবতে হয় আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব কতটুকু নিরাপদ। একটি জাতির জন্য ৪৬ বছর কম সময় নয়। আমাদের অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দেশ যতটা না সামনে এগোচ্ছে তার চেয়ে বেশি পিছু হটছে।
আমাদের স্বাধীনাতার পর থেকেই দেশি-বিদেশী নানা ধরনের ঘৃণ্যতর চক্রান্তের পদাঘাতে দেশ আক্রান্ত হলেও জনগণের দেশের প্রতি অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও পরিশ্রমপ্রিয়তার কারণে এখনো আশা জাগায়, মানুষ স্বপ্ন দেখে। সাধারণ মানুষ তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রম দিয়ে তিলে তিলে দেশকে গড়তে নিরন্তর চেষ্টা চালাচ্ছে।
৪৬ বছরে অসংখ্য দুর্যোগের ঘনঘটা আর নানা অপ্রাপ্তিতে আমরা বেদনাহত হই, মুষড়ে পড়ি। এরপরও অজানা এক শক্তিতে বুক বেঁধে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস আমাদের তাড়িত করে। ১৬ কোটি মানুষকে যদি জাগাতে পারি, ঘুণে ধরা সমাজের সকল অনাচার যদি শুধরে নিতে পারি, নৈতিক শিক্ষার বলে বলীয়ান করতে পারি, সর্বোপরি একটি দেশ সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা অনৈক্যের বিষবাষ্প থেকে যদি বেরিয়ে আসতে পারি, তাহলে হয়তো স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ সুখ পাবে জাতি। আমরা আশা নিয়ে বেঁচে থাকি, কারণ আমাদের তরুণরা মেধাবী ও সাহসী। তাদেরকে যদি আজ সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়া যায় তাহলে দেশ এগিয়ে যাবে।
আমরা বিজয়ের ৪৬ বছর অতিক্রম করছি। এ দীর্ঘ সময়ে আমরা একটি স্বকীয় জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে কতটুকু মাথা উঁচু করে দ্বাড়িয়েছে তা এখনো একটি বড় প্রশ্ন। একটি দেশের বয়স যত বাড়তে থাকে তার ঐক্য, সংহতি, গণতন্ত্র, বিচারব্যবস্থা, রাষ্ট্রপরিচালনা সুদৃঢ় হতে থাকে দেশের প্রজাতান্ত্রিক পদ্ধতির ওপর। এখন আমাদের সামনে একটি বঙ্কিম প্রশ্ন আমাদের প্রজাতান্ত্রিক পদ্ধতি কি গর্ব করার মতো পদক্ষেপ নিতে পেরেছে?
ডিসেম্বর মাস আসলেই আমরা হিসেব কষতে বসি দীর্ঘ এ সময়ে আমাদের কি প্রত্যাশা ছিল আর আমরা কি পেয়েছি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির সোনার বাংলা হয়তো আমরা হয়তো অনেকটা অর্জন করতে পেরেছি। তবে এখনো আমাদের নাগরিক অধিকারটুকু ঠিক মতো পাইনি।
এখনো নাগরিক সুবিধার বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে আমরা অনেক পিছিয়্ সবচেয়ে বড় কথা আমাদের দেশ এখনো দূর্নীতিতে বেশ এগিয়ে। এজন্য সোনার বাংলা গড়ার প্রথমে দরকার সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদের। আমাদের দেশটি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর থাকলেও আজ সৎ, দক্ষ নাগরিক, সাহসী মানুষ আর দেশপ্রেমিকের অভাব আজ সর্বত্র। কাজটি করতে হবে সবাইকে। এটি কারো একার কাজ নয়। সরকার-বিরোধী দল-সাধারণ মানুষ, প্রশাসন-ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে হাতে হাত মিলিয়ে কাজটি করতে হবে। কারণ বাংলাদেশ বাঁচলেই আমরা বাঁচব।
ছোট্ট এ ভূখন্ডকে ঘিরে আমাদের প্রত্যাশার কমতি নেই, এখনো এক বুক আশা বুকে চেপে বেঁচে থাকার সোনালি স্বপ্ন দেখে দেশের মানুষ।
নির্মলেন্দু গুন-এর একটি কবিতা দিয়ে শেষ করি,
‘জননীর নাভিমূল ছিঁড়ে উল্ঙ্গ শিশুর মত
বেরিয়ে এসেছো পথে, স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবী হও।
তোমার পরমায়ু বৃদ্ধি পাক আমার অস্তিত্বে, স্বপ্নে,
প্রাত্যহিক বাহুর পেশীতে, জীবনের রাজপথে,
মিছিলে মিছিলে; তুমি বেঁচে থাকো, তুমি দীর্ঘজীবী হও।
লেখকঃ শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
এসএম
![]() |
সম্পাদক : সুকৃতি কুমার মন্ডল খবর প্রেরণ করুন # info.eibela@gmail.com ফোন : +8801517-29 00 02 +8801711-98 15 52 a concern of Eibela Foundation |
|