আলেক্সান্ডার আমীর, যুক্তরাষ্ট্র: নিঃসঙ্গ মানুষ আমি। থাকি বোস্টন থেকে প্রায় ৮০ কি.মি. দুরে ছোট একটি শহর লিওমিনিস্টারে গত প্রায় ৫ বছর ধরে। পরিচিত কোনো বাংলাদেশী থাকে না আমার আশে-পাশে। তাই সময় কাটাবার জন্য বিচিত্র কিছু কাজ করি মাঝে মধ্যে।
সামারে মাছ ধরতে যাই স্থানীয় লেকে, বিলিয়ার্ড খেলি, পাহাড়ে চড়ি, দুরে অপরিচিত শহরে যাই। উইনটারে মোটামুটি গৃহবন্দী। একটানা টিভিতে মুভি দেখি, দেশের ছোটকালের রিক্সাচালক বন্ধু থেকে শুরু করে দেশের জাতীয় পর্যায়ে ব্যক্তিত্ব, এমন বন্ধুদের সাথে ফোনে কথা বলি।
এছাড়াও ইউরোপ আমেরিকাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাই বোনদের সাথেও আড্ডা দেই দীর্ঘ সময় নিয়ে। তবে সবচেয়ে বেশি যেই কাজটা করি তাহলো- মাঝে মাঝে জঙ্গলে গিয়ে একা বসে থাকি।
সাথে নিয়ে যাই ২/১ টা বাংলাদেশ থেকে আনা বই পত্তর। প্রকৃতির কথা মনোযোগ দিয়ে দিয়ে শোনার জন্য এর চেয়ে ভালো আর কি উপায় আছে ? জাগতিক দুনিয়ায় শ্রেষ্ঠ সুখ- সঙ্গীত তো প্রকৃতিতেই।
প্রকৃতি আসলে আমার দ্বিতীয় জীবন। প্রকৃতির মাঝে মিশে যেতে আমি অপার আনন্দ পাই। দিনের অনেক সময় ব্যয় করি বাংলাদেশে কাটানো প্রকৃতির সাথে আমার স্মৃতিগুলি মনে করে করে। গুগল সার্চ করে দেশী টাকি মাছের ছবি দেখি। ভাবখানা এমন যে, এই টাকি মাছগুলি কোনো এক জনমে আমার আত্মীয় ছিল। আসলেই এইসব পুটি - গজার - শিঙ মাছের সাথেই আমার শৈশব কেটেছে । এখন তো আর সেই দিন ফেরত পাব না।
তাই ইন্টারনেটে 'বিউটিফুল বাংলাদেশ' সার্চ করলে যে অদ্ভুত সুন্দর সুন্দর কিছু ছবি ভেসে আসে তা দেখেই ফিলিংস নেয়ার চেষ্টা করি। ‘ইন্টারনেটে দেশের ছবি দেখে চোখের কোণ ভিঁজে যায়। যখন দেখি, কোনো এক পাঁড়াগায়ের কিশোর বৃষ্টিতে ভিজে কাবাডি খেলছে, ফড়িং ধরার জন্য পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে, লাল-নীল ঘুড়ি উড়াচ্ছে ...। মনে হয় আমার কিশোর জীবনকেই যেন দেখছি। ফেসবুকেও অনেকে প্রিয় বাংলাদেশের রং বেরঙের ছবি তুলে এনে আপলোড করে। আমিও প্রিয়ার সুন্দর মুখ প্রথম দেখার মত করে তাকিয়ে থাকি দীর্ঘ সময়।
.jpg)
বাংলাদেশের প্রকৃতির ছবিতে চোখ বুঝেই লাইক দেই আর আফসোস করি নিজের রিফুঈজি জীবনকে নিয়ে। মনে মনে বলি, পুনর্জন্ম সত্যি হলে আবার এই বাংলাদেশেই জন্ম নেব। শত অভাব অনটন হলেও পরের জনমে এই বাংলাদেশ ছেড়ে কোথাও যাবো না।
আজকে বিকেলে শীত একটু কম। অনেকটা সামারের মত আবহাওয়া। লোভ সামলাতে পারলাম না। বাসা থেকে জঙ্গল বেশি দূরেও না। আসলে বাসা ঘেঁষেই জঙ্গল তবে অতটা নীরব না। মাত্র ২ মিনিট ড্রাইভ করলেই গহীন জঙ্গল। চলে আসলাম জঙ্গলে। আজকে যেখানে বসেছি সেখানে কাঠবিড়ালিসহ নানা প্রজাতির নাম না জানা প্রাণীর ছুটাছুটি । বসার কিছুক্ষণ পরেই একটা ঘ্রাণ পেলাম। সেই ঘ্রাণে আমার অজ্ঞান হবার অবস্থা। ৩০ বছর পরে এই ঘ্রাণটা আসল কোথা থেকে ? কত সময় যে এই ঘ্রাণের মোহময়ী সুখ আমার মগজে আঠার মত লেগেছিল তা নাইবা বললাম।
শুধু এইটুকু বলি ...আমি চাচ্ছিলাম না ঘ্রাণের এই অনুভব থেকে একটুও সরতে । এই ঘ্রাণ আমার দেহ - মনে যে স্বর্গসুখ তৈরী করেছিল তা বর্ণনা দেবার কোনো ক্ষমতাও আমার নেই । কয়েকবার বর্ণনার চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো। কিছু সুখানুভুতি আসলে বর্ণনার জিনিস না, কেবল অনুভবের।
আমি ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র ছিলাম এবং হোস্টেলেই থাকতাম। বিভিন্ন ছুটি ছাটায় নারায়ানগঞ্জ নিজের বাড়িতে যেতাম। আমাদের বাড়ি ঘেঁষে ব্রক্ষপুত্র নদী। নদী পার হলেই ওপারে বিস্তৃত গ্রাম ছিল। আমি নৌকায় উঠে অনেক ঘুরতাম আর একসময় নদীর ওপারের গ্রামে গিয়ে পাঁকা ধান খেতের আইলে গিয়ে বসতাম। আমার মনে আছে সেই ধানক্ষেতের উপর দিয়ে গরম বাতাস নেচে নেচে আসতো। আমি সেই পাকা ধান ছোঁয়া বাতাস নিঃশ্বাসের সাথে নিতাম প্রাণ ভরে। প্রখর রৌদ্রেও বেশ সময় নিয়ে চলত আমার সেই পাগলামি।

একটু আগে এখানকার জঙ্গলটায় কিভাবে যেন আমি সেই ঘ্রাণটাই পেলাম, একদম সেই ঘ্রাণ যা পেয়েছিলাম আমাদের অজো পাড়াগাঁয়ে আজ থেকে ঠিক ত্রিশ বছর আগে। আমি জানি, আগামী কিছুদিন আমার দিন খুব ভালো কাটবে, যতক্ষণ আমার নাক এই ঘ্রাণটা মুখস্ত রাখতে পারবে। লেখাটা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিযে থাকা সকল প্রবাসী বাংলাদেশীদেরকে উৎস্বর্গ করা হলো।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও সাবেক শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এইবেলা ডটকম/আমীর/এসএম