গাইবান্ধা জেলা গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস উপলক্ষে ৩০ জুন শনিবার সাপমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে বিক্ষোভ মিছিল, আদিবাসী-বাঙালী সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
সকাল ১০ টায় আদিবাসী-বাঙালিরা ব্যানার, ফেস্টুন ও লাল পতাকায় সজ্জিত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে জয়পুর-মাদারপুর এলাকা থেকে বরে হলে কাটা মোড় এলাকায় পুলিশি বাধার মুখে পড়ে। এসময় পুলিশি বাধা অতিক্রম করে তারা সাপামারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে পৌঁছায়। সেখানে অস্থায়ী শহীদ বেদিতে সিদু, কানুসহ সাঁওতাল বিদ্রোহে নাম না জানা শহীদ ও বাগদাফার্মে পুলিশের গুলিতে নিহত শ্যামল-রমেশ-মঙ্গলসহ সকল শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুস্পস্তবক অর্পণ এবং প্রয়াতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি, আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ইউনিয়ন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ ও জনউদ্যোগ যৌথভাবে এ সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশের শুরুতেই আদিবাসী শিল্পীরা প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে।
সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সিপিবি’র প্রেসিডিয়াম সদস্য মিহির ঘোষ, আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদের আহবায়ক এ্যাড. সিরাজুল ইসলাম বাবু, আদিবাসী যুব পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি হরেন্দ্রনাথ সিং, জনউদ্যোগ কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য সচিব তারিক হোসেন, আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদের সদস্য সচিব প্রবীর চক্রবর্তী, জেলা বাসদ সমন্বয়ক গোলাম রব্বানী, সিপিবি উপজেলা সভাপতি তাজুল ইসলাম, সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাফরুল ইসলাম প্রধান, এ্যাড. মুরাদজ্জামান রব্বানী, মানবাধিকার কাজী আব্দুল খালেক, গণেশ মুর্মু, সুফল হ্রেমব্রম, থমাস হেমব্রম, বার্নাবাস টুডু, রেজাউল করিম, স্বপন শেখ, প্রিসিলা মুর্মু, অলিভিয়া মার্ডি প্রমুখ।
সমাবেশে বক্তরা বলেন, সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্মের নিরীহ আদিবাসী-বাঙালিদের উপর সংঘটিত হামলার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত এবং আখ চাষের নামে রিক্যুজিশনকৃত ১৮৪২.৩০ একর বাপ-দাদার জমিতে আদিবাসী ও প্রান্তিক বাঙালি কৃষকদের আইনগতভাবে জমি ফেরত দেয়ার দাবিসহ সাত দফা অবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবী জানান।
সমাবেশে সিপিবি’র প্রেসিডিয়াম সদস্য মিহির ঘোষ বলেন, এই আদিবাসী সাঁওতালরা বৃটিশ আমলে জীবন দিয়েছে তেমনি মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছে কিন্তু তারপরেও আজ এই স্বাধীন দেশে কেন আদিবাসীদের জমি-জলা-জঙ্গল হারাতে হচ্ছে। ২০১৬ সালে এই এলাকায় তিনজন সাঁওতালকে হত্যা করা হলো, বাগদাফার্মের আদিবাসীরা বাড়ি-ঘর হারিয়ে মানববেতর জীবন যাপন করছে। স্কুল ঘর পুড়িয়ে দেয়ার কারণে তাদের সন্তানেরা ২ বছর হলো পড়াশুনা করতে পারছে না। স্থানীয় প্রশাসনকে এ বিষয় অবহিত করা হলেও কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। আদিবাসীরা কি এ দেশের মানুষ না?
সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ডা. ফিলিমন বাস্কে বলেন, সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্মের ১৮৪২.৩০ একর সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য আমরা গত কয়েক বছর ধরে লড়াই সংগ্রাম করে যাচ্ছি। কিন্তু চিনিকলের নামে আমাদের সম্পত্তি এখনো অবৈধভাবে দখল করে রাখা হয়েছে। চিনিকল কর্তৃপক্ষের যেখানে আখ চাষ করার কথা সেখানে ধান, বেগুন, আলু এমনকি তামাক চাষ করা হচ্ছে লীজ প্রদানে মাধ্যমে। উল্টো নিজেদের পৈত্রিক সম্পত্তিতে আদিবাসী-বাঙালিদের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হচ্ছে। অনতিবিলম্বে ওই জমি ফিরিয়ে দিয়ে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য সরকারের নিকট তিনি জোর আহ্বান জানান।
আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদের আহবায়ক এ্যাড. সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, আজকে একটি ন্যায্য দাবিতে বাগদাফার্মে আন্দোলন চলছে। আজ এই আন্দোলন শুধু বাগদাফার্মের নেই। এটা গোটা উত্তরাঞ্চলের আদিবাসী-বাঙালিদের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, সংবিধানের ৭ (১) ধারাতে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ কিন্তু বাগদা ফার্মের উদাহরণ বলে এদেশের মালিকদেরকেই শোষণ করা হচ্ছে। ৩ জন আদিবাসী সাঁওতাল নিহত হলো, অনেকেই আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে দুর্বিসহ জীবন-বরণ করছে তার কোন বিচার বা ক্ষতিপূরণের দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাফরুল ইসলাম বলেন, বাগদা ফার্মে গত ৬ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে যে হামলা হয়েছে সেটি একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধকেও হার মানিয়েছে। কারণ স্বাধীন দেশে দিনে দুপুরে মানুষের উপর অন্যায়ভাবে হামলা করে সাঁওতালদের হত্যা, নির্যাতন, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
সমাবেশে বক্তারা আরো বলেন, উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ণের পেছনে ভূমি দখলই প্রধান কারণ। এখন পর্যন্ত যত ঘটনা ঘটেছে তার সবটাই ভূমিকে কেন্দ্র করে ঘটছে। এসব ঘটনায় প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল করেই চলেছে।
বক্তারা আরো বলেন, গত ৬ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে বাগদাফার্মে হামলার পরে এখনো সেখানে আদিবাসী-বাঙালিরা খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। পুলিশ ও চিনিকল কর্তৃপক্ষের দায়েরকৃত মিথ্যা মামলায় এখনো ক্ষতিগ্রস্থরা আতঙ্কিত জীবনযাপন করছে। তারা অবিলম্বে সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের উদ্বাস্তু মানুষদের তাদের বাপ দাদার জমি ফেরতের দাবি এবং ওই হত্যাকান্ডের সকল আসামীকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচার শুরু করার দাবি জানান।
প্রসঙ্গত,বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে সাঁওতাল সম্প্রদায় অন্যতম। এই সাঁওতাল জাতির বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস রয়েছে। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন ভারতের বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যের সাঁওতাল পারগানা জেলার ভগনাডিহি গ্রামের সিঁদু, কানু, চাঁদ, ভৈরব, ফুলমনি, ঝানো প্রমুখের নেতৃত্বে জমিদার ও মহাজনদের ঠকবাজি, পুলিশ দারোগাদের নির্যাতন, জুলুম ও অত্যাচার, শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে শোষণহীন সমাজের লক্ষ্যে দশ হাজার সাঁওতালদের শপথ গ্রহণ এবং কলকাতা অভিমুখে গণযাত্রা ছিল ইতিহাস খ্যাত হুল বা সাঁওতাল বিদ্রোহ।
দামিন-ই-কোহ অঞ্চলের সাঁওতাল, কামার, কুমার, গরীব মুসলমানসহ অত্যাচারিত সকল জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষ সকলেই এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে। প্রায় দশ হাজারেরও অধিক বিদ্রোহী এই বিদ্রোহে শহীদ হন। এই বিদ্রোহ দমনে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত কয়েক হাজার ব্রিটিশ সৈন্য তীর-ধনুকে সজ্জিত আদিবাসী বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। দীর্ঘ প্রায় ৮ মাস এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়।
বিকে/বিডি