বলা হয় যে, 'মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়'। আসলেই তাই। আমার অকৃত্রিম বন্ধু 'জীবনে'র বেলায় কথাটি খুবই প্রযোজ্য। সে এখন 'Technomedia group" এর কর্নধার। যা স্বপ্ন দেখেছে, যেখানে হাত দিয়েছে- সেখানেই সোনা ফলেছে। শৈশব, কৈশোর, যৌবন সহ তার জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, বিরহ-বেদনার সব খুঁটি নাটি নিয়ে সে লিখছে 'জীবনের গল্প'। জমেছে বেশ। সবাই গোগ্রাসে গিলছে। ফেসবুকে সে ১৭ পর্ব লিখে ফেলেছে অলরেডি। অধীর আগ্রহ নিয়ে সবাই পড়ছে তার এই গল্প। সময় করে আমিও পড়ি। চমৎকার সুখপাঠ্য। আছে সীমাহীন দারিদ্র্যতা, চ্যালেঞ্জ। বলা যায় কঠিন এক জীবনযুদ্ধ। বেদনার করুন রসে সিক্ত।
অন্যদিকে হাঁসি কান্না ও রোমান্টিকতাও আছে। জীবনে'র এই গল্প একদিন নিশ্চয়ই বই আকারে প্রকাশিত হবে এবং আমি আমার আলমিরায় এক কপি সংরক্ষন করবো নিশ্চয়ই। তবে সংগত কারনেই তার এই গল্পে আমার প্রসঙ্গও এসেছে একাধিকবার এবং অনেক ঘটনা আমার দেখা ও জানা। সেইজন্য আমার বাড়তি কৌতূহল আছে। চাইলে আমার ফেসবুকের বন্ধুরাও তার লেখা পড়তে পারবেন। নিশ্চয়ই উপভোগ্য হবে। 'জীবনে'র সব চাইতে বড় গুন হলো- তার ঝুঁকি নেবার সাহস, তার সততা ও ভিশন। আমি মনে করি সাহসী মানসিকতাই তার জীবন চলার পথের অন্যতম শক্তি। সে এখন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। পরপর ৪ বার CIP-(Commercial Important person) নির্বাচিত হয়েছে। অথচ সে তার প্রারম্ভিক জীবনের নিদারুন কষ্ট ও দরিদ্রের কথা এইখানে অকপটে বিবৃত করেছে। এইভাবে বলবার সৎ সাহস সবার থাকে না। যিনি বলতে পারেন- তিনি আলাদা,অনন্য। আবার সফল মানুষ ছাড়া আমাদের মত সাধারন কেউ এই রকম গল্প বলতে চাইলে তেমন আগ্রহ নিয়ে কেউ শুনবেও না হয়ত।
তার এই গল্পের মধ্যেই জেনেছেন, ঐ সময়ে 'অজয়- জীবন- বাবুল'- ফরিদপুরের অবিচ্ছেদ্য ত্রয়ী। বলা যায় 'থ্রি মাস্কেটিয়ার্স,। আমি আর অজয় প্রথম বর্ষ থেকেই একই সংগঠনের ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়লেও জীবন কখনই রাজনীতি পছন্দ করতো না। বাট, এই রাজনীতি কখনোই আমাদের বন্ধুত্বে এতটুকু বাঁধা হতে পারে নাই। রাজেন্দ্র কলেজের ইন্টারমিডিয়েট সেকশন থেকে শুরু করে বায়তুল আমান ভবন এবং শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত- সব জায়গাতেই আমাদের বিচরন ছিলো অবারিত। বলতে গেলে কারনে অকারনে আমরা টো টো করে চষে বেড়িয়েছি এই শহর। আছে অনেক সুখ দুঃখ, ভালো লাগা, মন্দ লাগার কাহিনী। কতবার যে দুইজনের খাবার তিনজনে ভাগ করে খেয়েছি- তার হিসেব নেই। আমাদের পকেটে তখন অত বেশি টাকা পয়সা না থাকলেও-আমরা যে খুন অনটনে দিন পার করেছি এমন নয়। কখনও এক রিকশায় তিনজন বা কখনও পদব্রজেই হেঁটেছি, চলেছি। তাছাড়া ফরিদপুর তো এমন কোন বড় শহর নয়। আজ থেকে ৩০/৩২ বছর আগের কথা। তখন ফরিদপুর ছিলো ছায়া সুনিবিড় শান্ত ও নিরিবিলি শহর ছিলো। ছিলো না কোন যানজট বা কোলাহল। সবাই সবাইকে চিনতো। আজকের দিনের মত এত বড় পরিসর, সার্কেল ও শুভাকাঙ্খী না থাকলেও- বলতে দ্বিধা নেই, ঐ সময় গুলোই ছিলো আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়! কতই না মধুময় ছিলো সদ্য কৈশোর উত্তীর্ন সেই নব জীবন। আহা!
"দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না,
সেই যে আমার নানা রংয়ের দিনগুলি''!
আমি রাজনীতিতে যোগ দিয়েছি- একথা জেনে আমার আত্মীয়, পরিজন, বন্ধু বান্ধব, আমার স্কুলের শিক্ষক সবাই আফসোস করে বলতো- আহা তবে কি এই রকম একটি সুবোধ ছেলে রাজনীতিতে জড়িয়ে জীবনটা বিপথে পরিচালিত করলো।
অনাগত জীবনে আমাদের কার কি লক্ষ্য- তা নিয়ে কথা হলেই জীবন বলতো- তোরা যখন এমপি, মন্ত্রী হবি- আমি ততদিন শিল্পপতি হয়ে যাবো। এখন প্রায়ই জীবন আমাকে মজা করে বলে- ''চান্দু আমি তো ঠিকই শিল্পপতি হয়েই গেলাম, বাট তুই তো এখনও কিছুই হতে পারলি না''। কখনও কখনও আমাকে 'ফেল্টুস' বলেও ডাকে। আমি তাকে পর্যুদস্ত করবার জন্য বলি-হবে, হবে একটু ধৈর্য্য ধরো। মনে রাখবা- 'স্বর্নকারের ঠুক ঠাক- কামারের এক ঘা' !
আবার এভাবেও বলি,'উস্তাদের মাইর শেষ বেলাতে'।
এইভাবেই কাটছে দিন। আর আমাদের 'অজয়' তো অকালেই বিয়ে করে 'চাকরি' কেই তার জীবনের ব্রত হিসাবে বেঁছে নিলো। অনেক চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে চাকুরী, ব্যবসা সব মিলিয়ে সেও এখন একজন সফল মানুষ। দুই কন্যার জনক। তার বড় মেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। বাট শুধু আমারই জীবনই আটকে রইলো ব্যর্থতার এক গোলক ধাঁধায়। কেবল দুঃখ, কষ্ট আর প্রতিবাদ বিক্ষোভের মধ্যেই কাটলো জীবনের স্বর্ণালী সব সময়। সফল মানুষ বলতে যা বুঝায়- তার কিছুই হতে পারি নাই আমি। তবে সাফল্য না পাইলেও এত এত সব ভাই, বন্ধু ও প্রিয় মানুষদের যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি- তা আমার জীবনের অমূল্য সম্পদ। এই 'মনিহার' ধারন করবার সাধ্য আমার নাই।
আমাদের সেই স্বর্ণালী সময়ে আরও বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমরা পেয়েছিলাম।
অনেকেই আমাদের আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছিলো। পেশাগত জীবনে অনেকেই ঈর্ষনীয় সফলতা পেয়েছে। প্রায় সবার সাথেই সম্পর্ক এখনও অব্যাহত আছে। তাদের মধ্যে যাদের নাম মনে পড়ে ------
বৈরী সময় ও বাস্তবতার কারনেই 'জীবনে'র সাথে আমার এই বন্ধুত্বের কথা পারত পক্ষ্যে আমি কাউকে বলতে চাই না। কারন সে ব্যবসা করে। বাট রাজনীতির বাইরে তিন দশকের বেশি সময়ের এই অন্তরঙ্গতা তো অস্বীকার করা যায় না, ছুড়েও ফেলা যায় না। তবে ইদানিং তার সাথে আমার কমই দেখা সাক্ষাৎ ও কথা বার্তা হয়।
'জীবনে'র একটি কঠিন ট্রাজিডি আছে। তার একমাত্র ছোট ভাই ছিলো সুদর্শন। আমাকে খুব সম্মান ও মায়া করতো। আমার দেখা খুব ভদ্র ও বুদ্ধিমান ছেলে। সাফল্য যখন কেবল জীবনকে ধরা দিতে শুরু করেছে, এমন একদিন তার প্রিয় ছোট ভাইটি নিমেষেই হারিয়ে গেলো তার চোখের সামনে থেকে। নির্মম ও নিষ্ঠুর সেই দুর্ঘটনা ! সম্ভবত ২০০৩ সালের কথা। তখনও জীবনের নিজের কোন গাড়ি নাই। দুই ভাই কাঁটাবনে নিজেদের অফিস থেকে একসাথে ইস্কাটনের বাসায় ফিরছিলো। হঠাৎ পরিবাগে রাস্তা পার হবার সময় ঘটে এই অবর্ননীয় দুর্ঘটনা। জীবন ছিলো সামনে, সুদর্শন ছিলো পিছনে। জীবন কোনক্রমে রাস্তা পার হতে পারলেও- একটি বেপরোয়া ঘাতক বাস পিছন থেকে সুদর্শনকে পিষে দিয়ে চলে যায়। সেই অবস্থায় জীবন তার ভাইয়ের রক্তাক্ত ও ক্ষত বিক্ষত দেহটি কোলের উপর নিয়ে হাউ মাও করে কাঁদতে থাকে। এই অসহায় অবস্থাতেই সে আমাকে ফোন করে চিৎকার করে বলতেছিলো- সুদর্শন আমার হাতের উপর ছটফট করে মারা যাচ্ছে। আহা ! বেদনা বিধুর সেই দিনের কথা আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে। বাট আমার দুর্ভাগ্য ঐ সময়ে আমি ঢাকার বাইরে ছিলাম। সাথে সাথে আমি সবাইকে ফোন করে পিজি হাসপাতালে পাঠালেও- সুদর্শন দুর্ঘটনা স্পটেই মারা গিয়েছিলো।
রাতে ঢাকায় ফিরে সুদর্শনের ক্ষত বিক্ষত মুখটাই শুধু একবার দেখতে পেয়েছিলাম। একেবারে রক্তশুন্য বিবর্ন ও পাণ্ডুর সেই মুখ। অথচ কত মায়াবী ও সুন্দর মুখাবয়ব ছিলো সুদর্শনের। এখনও কারনে-অকারনে সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত এই শান্ত সৌম্য যুবকের অকাল পরিনতি ও ট্রাজিডির কথা মনে পড়লে ভেতরটা হাহাকার করে উঠে। বেঁচে থাকলে জীবনের জন্য কতই না সহায়ক হতো, জীবনের তো অনেক কিছুই করবার ছিলো তার এই হতভাগ্য ভায়ের জন্য। জীবন তার গ্রামের বাড়িতে সুদর্শনের স্মরনে একটি স্মৃতি ক্লাব করেছে। তার মাধ্যমে সে অনেক সেবামূলক কাজ করে থাকে। এটাই এখন তার শান্তনা।
জীবনের চরিত্রের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো- তার উদার ও বৃহৎ মানসিকতা। কার্পন্যকে সে কোনদিনই প্রশ্রয় দেয় নাই। ধার করে টাকা এনে বন্ধু বান্ধবদের সাথে খরচ করেছে উদারভাবে। ১০০ টাকা পকেটে থাকলে তা খরচ করতে তার এক ঘন্টাও লাগত না। আবার যখন নাই তো খরচ নাই। বিলাস বসনের চলন প্রথম থেকেই তার পছন্দ। আমি সম্ভবত '৯৯
সালে মোবাইল ফোন ব্যাবহার শুরু করি। জীবন তারও দুই তিন বছর আগে থেকেই 01819----- নাম্বারের মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। আজও সেই নাম্বারটিই তার হাতে আছে। সম্ভবত এই কারনে প্রথম থেকেই তার বেশি বেশি আয় করবার মানসিকতা তৈরি হয়েছিলো। সেজন্য বার বার চাকরি পরিবর্তন, বিয়ের পরে নিরাপদ ও ভালো চাকরি ছেড়ে ব্যবসা বানিজ্যের মত ঝুঁকিপূর্ন কর্মকান্ড শুরু করা তার পক্ষেই সম্ভব ছিলো। যদিও আমি তখন তাকে চাকরি ছাড়ার কথা বারন করেছিলাম। সাম্প্রদায়িকতা বা বর্নভেদ কোনদিন তাকে স্পর্শ করেছে বলে আমি দেখিনি।
তবে কেউ কেউ বলেছে, ইদানিং কখনও কখনও প্রিয় মানুষদের সাথেও আচরনে জীবন কিছুটা কাঠখোট্টা ও ভাবলেশহীন। বলা যায় ইমোশন বা আবেগের ঘাটতি। হতে পারে এটা তার বেশি ব্যস্ততার কারনে। বাট,ইমোশনটা তো থাকতে হবে। শুধু এইটুকু বাদ দিলে বাকি যা থাকে - সব মিলিয়ে তা অসাধারন। জীবন চ্যালেঞ্জ গ্রহন করতে খুব পছন্দ করে। আমি মনে করি, জীবনের এই কঠিন দারিদ্রতাই তার ভূষন। এই দারিদ্রতাই তাকে আজকের এই পর্যায়ে আসতে সহযোগিতা করেছে। কবি নজরুলের কথায়,
''হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছো মহান,
তুমি মোরে দানিয়াছো খ্রীষ্টের সম্মান"।
নিজের মেধা, বুদ্ধি, কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসয়ের মধ্য দিয়ে একবারে প্রান্তিক পর্যায় থেকে উঠে আসা এই রকম একজন সফল মানুষ নিশ্চয়ই আজকের হতাশাগ্রস্থ তরুন প্রজন্মের রোল মডেল হতে পারে। 'জীবন' একেবারেই 'সেলফ মেড' একজন মানুষ। মানুষের জীবনে প্রতিকূলতা থাকবে, চ্যালেঞ্জ আসবে। দুঃখ, কষ্ট, দারিদ্রতাও থাকতে পারে। কিন্তু আস্থে আস্থে সব প্রতিকূলতা দু হাতে দূরে সরিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। তাহলে সাফল্য হাতের মুঠোয় ধরা দিতে বাধ্য- আমাদের 'জীবন' হতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরন।"চলবে....
নি এম/শহিদুল ইসলাম
Editor & Publisher : Sukriti Mondal.
E-mail: eibelanews2022@gmail.com