গান শোনা, গাওয়া আর গান নিয়ে লেখালেখি ছিল তার নেশা। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে লৌকিক গৌণধর্ম বিষয়ে সরেজমিনে সন্ধান করেছেন। সাহেবধনী, বলরামী, কর্তাভজা ও লালনপন্থীদের সম্পর্কে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ তিনি। ১৯৯৯ সালে ভাষণ দেওয়ার জন্য পাড়ি জমিয়েছিলেন আমেরিকার টেক্সাসের আর্ভিং শহরে।
গবেষণা হোক কিংবা লোক-সমাজ, আদিবাসীদের যাপনচিত্র অনুসন্ধানে বারবার তিনি ছুটে গেছেন প্রান্তিক অঞ্চলে। দিন কাটিয়েছেন মাটির গন্ধঘেঁষা মানুষদের সঙ্গে। বিশেষ করে লোকসংস্কৃতি, লোকসঙ্গীতের ওপর করেছেন দীর্ঘ অনুসন্ধান।
রবীন্দ্রনাথ থেকে লালন, বাউল সংস্কৃতি থেকে গ্রাম বাংলার মৃৎশিল্প, চিত্রকলা সবকিছুই বারবার হয়ে উঠেছে তাঁর গবেষণার বিষয়। গবেষণা ও রচনার পাশাপাশি করেছেন দীর্ঘদিন সম্পাদনার কাজও। কৃষ্ণনগর থেকে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে প্রকাশ করেছেন সংস্কৃতি ও মননের পত্রিকা ধ্রুবপদ।
৩০টিরও বেশি বই লিখেছেন সুধীর চক্রবর্তী। গবেষণামূলক প্রবন্ধের পাশাপাশি লিখেছেন মৌলিক রচনা এবং আখ্যানধর্মী বেশ কিছু গ্রন্থ। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘গভীর নির্জন পথে’, ‘লালন’, ‘পঞ্চগ্রামের কচড়া’, ‘আখ্যানের খোঁজে’, ‘বুদ্ধিজীবীর নোটবই’, ‘রবিকর রেখা’, ‘বাউল ফকির কথা’ প্রভৃতি।
‘বাউল ফকির কথা’ গ্রন্থটির জন্য পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার। ২০০৪ সালে এই বইটির জন্য সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কারের সম্মাননাও পান সুধীর চক্রবর্তী। তাছাড়াও শিরোমণি পুরস্কার, দীনেশ চন্দ্র সেন পুরস্কার, নরসিংহ দাস পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। দীর্ঘ অক্লান্ত অধ্যাপনাজীবনের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানিত করেছে সরোজিনী নাইডু স্বর্ণপদক এবং ‘বিশিষ্ট অধ্যাপক’ খেতাবে।
১৯৯৪ সাল পর্যন্ত কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজে অধ্যাপনা করেছেন বাংলা সাহিত্যের। দীর্ঘ অধ্যাপনার জীবন থেকে অবসরের পরও ছেদ পড়েনি শিক্ষকতার সঙ্গে। অবসরের পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর তুলনামূলক সাহিত্যে ক্লাস নিয়েছেন তিনি। পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাবড়া শ্রীচৈতন্য কলেজে স্নাতকোত্তর বাংলা বিভাগে পড়িয়েছেন অতিথি অধ্যাপক হিসেবে।
শহুরে জীবনের সঙ্গে গ্রাম বাংলার প্রকৃতির মধ্যে বন্ধনের সেতু নির্মাণ করেছিলেন সুধীর চক্রবর্তী। বাংলার মননে সংস্কৃতির জাল বুনে দিতে শেষ বয়স অবধি কলম ধরে রেখেছিলেন তিনি। বার্ধক্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েও চালিয়ে গেছেন সাহিত্যরচনার কাজ। এসবের মধ্যেই হঠাৎ যে এভাবে বিদায় নেবেন তিনি, তা যেন সবার কাছেই অপ্রত্যাশিত।
নি এম/
E-mail: info.eibela@gmail.com