সদ্য মাধ্যমিক পাশ করা এক কিশোর। বাড়ি ছেড়ে সোজা চলে এসেছে বেলুড় মঠে। সাধু হবে বলে। মন সংসারের বাঁধনে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধতে চায় না। ফিরিয়ে দিলেন মিশনের তৎকালীন অধ্যক্ষ স্বামী মাধবানন্দ। “এতটুকু ছেলে সন্ন্যাসী হবে কী, যাও বাড়ি ফিরে পড়াশোনা করো।“ মহারাজের কথায় মন ভারাক্রান্ত, ফিরে গেল কিশোর কিন্তু মন পড়ে রইল মিশনেরই চৌকাঠে। কৈশোর থেকে বয়ঃসন্ধি—বারে বারেই এক অদম্য নেশায় মঠ-মিশনের দোরে দোরে ঘুরল অবাধ্য মন। শেষে সাক্ষাৎ ‘গুরুজি’র সঙ্গে। সেটা সত্তরের দশক হবে। গুরুজির কথাগুলো যেন কানে অমৃতবর্ষণ করল যুবকের, “এই পথ তোর জন্য নয়। তুই অন্য ভাবে দেশের কাজ করবি।“
ফিরে গিয়েছিলেন যুবক। কিন্তু বেলুড় মঠ ও মিশনের সঙ্গে আত্মার যে বাঁধন জড়িয়ে গিয়েছিল সেটা আর ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি। বারে বারেই ফিরে এসেছেন। সেদিনের সেই যুবক আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আর তাঁর শ্রদ্ধেয় গুরুজি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের পঞ্চদশ অধ্যক্ষ স্বামী আত্মস্থানন্দ।
শনিবার রাতে বেলুড় মঠে পা রাখার আগে থেকেই যাঁর অভাবে এক শূন্যতা গ্রাস করছে প্রধানমন্ত্রীর মনের আনাচেকানাচে। এই গুরুজিই পথ দেখিয়েছিলেন তাঁকে। জীবনের যে কোনও বড় কাজ গুরুজির চরণ ছুঁয়েই শুরু করেছেন তিনি।
২০১৪ সালের ২৬ মে। সন্ধ্যে ৬টা ১৩ মিনিট। পঞ্চদশতম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদী যখন রাষ্ট্রপতি ভবনে শপথবাক্য পাঠ করছিলেন, তাঁর পকেটে ছিল বেলুড় মঠ থেকে পাঠানো ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের প্রসাদী ফুল। সেই ফুল পাঠিয়েছিলেন তাঁর শ্রদ্ধেয় ‘গুরুজি’। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগেই ঘুরে গিয়েছিলেন কলকাতার বেলুড় মঠে। শপথ গ্রহণের আগেই বেলুড় মঠ থেকে দিল্লির গুজরাত ভবনে তাঁর হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল এই প্রসাদী ফুল। সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ মুদ্রা। ঠাকুরের চরণছোঁয়া সেই মুদ্রা মাথায় ঠেকিয়েই শপথবাক্য পাঠ করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী।
“রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রতি আমি খুবই সংবেদনশীল,” প্রধানমন্ত্রীর মুখে এইকথা শোনা গেছে বহুবার। মোদী নিজেই জানিয়েছেন, রাজনীতির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই বেলুড় মঠের। আত্মার টানেই বারবার সেখানে ছুটে যান তিনি।
সন্ন্যাস নেননি ঠিকই, কিন্তু রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের ভাবধারা তাঁর শিরায়-উপশিরায় বয়ে চলে সবসময়। এই টান হঠাৎ করে আছড়ে পড়া কোনও অনুভূতি নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর জীবনের নানা কাহিনি, বলেছেন মোদী নিজেই। শুরুটা হয়েছিল সেই ষাটের দশকেই। কিশোর মোদী বাড়ি থেকে পালিয়েছেন। লক্ষ্য, সন্ন্যাসী হবেন।
স্বামীজির জন্মদিনে সাতসতালে বেলুড় মঠে আরাধনায় প্রধানমন্ত্রী
প্রথমে পাড়ি হিমালয়ে। তিন মাস কোনও খোঁজ নেই। নানা সাধুসঙ্গে ঘুরেও মন শান্ত হয়নি। একদিন গেলেন আলমোড়ায় রামকৃষ্ণ মিশনে। উদ্দেশ্য একই, সন্ন্যাসী হওয়া। দু’মাস থাকার পরে সেখান থেকেও মোদীকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপরে রাজকোটের কলেজে পড়াশোনা শুরু। কিন্তু মন মানে না। একটা ছন্নছাড়া অস্থির ভাব। একদিন কলেজ থেকে সটান গেলেন রাজকোটের আশ্রমে। রাজকোট মিশনের সচিব তখন স্বামী আত্মস্থানন্দ। মিশনেরই এক সতীর্থ সন্ন্যাসীর মাধ্যমে মোদী দেখা করলেন স্বামী আত্মস্থানন্দের সঙ্গে।
সেই প্রথম সাক্ষাৎ। বদলে যায় তাঁর জীবন। মোদীকে সন্ন্যাস ধর্মের মন্ত্র দিতে রাজি হননি স্বামী আত্মস্থানন্দ, কিন্তু সম্পর্ক ছিন্ন করতেও বলেননি। রাজকোটের আশ্রমেই ব্রহ্মচারীর মতো থাকতে শুরু করেন মোদী। একসময় স্বামী আত্মস্থানন্দের স্নেহভাজন হয়ে ওঠেন মোদী। নিত্য যাতায়াত শুরু হয় আশ্রমে। স্বামী আত্মস্থানন্দই মোদীকে বেলুড় মঠের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মহারাজ স্বামী মাধবানন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। তিনিও ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন মোদীকে। সন্ন্যাস জীবনের বদলে দেশ ও সমাজ সংস্কারের কাজ করার অনুপ্রেরণা দেন।
সাধু হওয়া হয়ে ওঠেনি, কিন্তু এক বাঁধন তৈরি হয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের সঙ্গে। এরপরে যতবারই মোদী বেলুড় মঠে গেছেন সেখানে স্বামী বিবেকানন্দের ঘরে বসে ধ্যান করেছেন। দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন তাঁর গুরুজি স্বামী আত্মস্থানন্দের ঘরে। তাঁর প্রয়াণকে ব্যক্তিগত ক্ষতিও বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এবার বেলুড় মঠে এসে গুরুজির দেখা না পাওয়ার যন্ত্রণার কথাও টুইট করে বলেছেন তিনি। মোদী বলেছেন, “তবুও, একটা শূন্যতাও থাকবে! যিনি আমাকে ‘জন সেবাই প্রভু সেবা’র মহৎ নীতিটি শিখিয়েছিলেন, সেই শ্রদ্ধেয় স্বামী আত্মস্থানন্দজি এখন আর নেই। রামকৃষ্ণ মিশনে গিয়ে তাঁর পবিত্র সান্নিধ্য না পাওয়াটা অকল্পনীয়!”
নি এম/
Editor & Publisher : Sukriti Mondal.
E-mail: eibelanews2022@gmail.com